চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় বণ্টনের অভাবে

“খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, হয়েছে সুষম বণ্টনের অভাবে।”- কথাটি বলেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সাম্প্রতিক এই করোনাকালে জাতিসংঘসহ দেশে-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা খাদ্য বিপর্যয় তথা দুর্ভিক্ষ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করায় বিষয়টি নিয়ে একটু পড়তে গিয়ে ড. সেনের এই বাণী নজরে এলো।

তার বাণী বিশ্লেষণের আগে দেখে নেই, দুর্ভিক্ষ জিনিসটি আসলে কী? অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতির কারণে কোনো এলাকার মানুষের অনাহারজনিত চরম অবস্থা। সাধারণত কোনো এলাকায় ফসলহানি ঘটলে এবং সেখানে প্রয়োজন মেটানোর মতো খাদ্য সরবরাহ না থাকলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এছাড়াও খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে, গবাদিপশুর রোগ বা ফসলের রোগ, পশু-কীটপতঙ্গ বা ইঁদুররাও অনেক সময় দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী হতে পারে। এর বাইরেও ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ও খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চালু বাণিজ্যপ্রবাহে বাধা আসলে অনেক সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।

নানা বৈশ্বিক সঙ্কটের সময়ের জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে পুরো বিশ্ব। তারা কী করছে, কী বলছে, তা গুরুত্ব দেয়া হয় দিকনির্দেশনা হিসেবে। করোনাকালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) (২৩ এপ্রিল ২০২০) বলেছে, “করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত হতে পারে, যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যে মানুষ না খেতে পেয়ে আক্ষরিক অর্থে মারা যাবে। কয়েক মাসের মধ্যেই বাইবেলে বর্ণিত পরিস্থিতির মতো একাধিক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারি আমরা। এ কথা সত্য যে আমাদের হাতে আর সময় নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। চার সপ্তাহ পরই দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। কিংবা আমরা কয়েক মাস সময় পেতে পারি। এখন জরুরি দরকার অর্থ। আর শুধু অর্থ পেলেও চলবে না। সেই সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ করার নিশ্চয়তা লাগবে। যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল।” জাতিসংঘের এই কথাকে পাত্তা না দিয়ে চরম আশাবাদী হয়ে যদি ধরেই নেই, পরিস্থিতি এতো খারাপ হবে না। তারপরেও যা হবে, তাও কিন্তু চরম চিন্তার!করোনাভাইরাস

অতীতে দেশে নানা ইস্যুতে পক্ষেবিপক্ষের নানা সূচক আর গবেষণাকে বেশ গুরুত্ব নয়তো সরাসরি প্রত্যাখানের সংস্কৃতি রয়েছে। করোনা নিয়ে প্রকাশিত নানা সূচকেও সেরকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে এইসময়েও। গত ৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গ্লোবাল থেকে ‘গ্লোবাল রেসেলিয়ানস ইনডেক্স-২০১৯’ বা বৈশ্বিক সহিষ্ণুতা সূচক-২০১৯ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সঙ্কট কোন দেশ, কতো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, তা ওই সূচকে বোঝা যাবে বলে ধরা হচ্ছে। সেখানে দেখা গেছে, ১৩০টি দেশের মধ্যে ওই সূচক অনুযায়ী শীর্ষ তিনটি দেশ হচ্ছে নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ড। আর ওই তালিকায় সবার নিচের দিকে থাকা তিনটি দেশ হচ্ছে হাইতি, ভেনেজুয়েলা ও ইথিওপিয়া। আর বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে ১৩০টি দেশের মধ্যে ১০৬ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ৫৮ ও ৮১। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশের রেজেলিয়ান্স বা সহিষ্ণুতার ক্ষমতা কম। ওই সূচক তৈরি করা হয়েছে মূলত দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, করপোরেট সুশাসন ও ব্যবসার পরিবেশকে আমলে নিয়ে। এই বিষয়গুলো যে দেশে ভালোমতো চলছে, সেই দেশের পক্ষে করোনাভাইরাসের মতো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতের চাপ সহ্য করার সক্ষমতা তত বেশি থাকবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে লকডাউন। খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। দেশে অর্থনীতির চাকা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। স্থবির হয়ে গেছে প্রবাসী রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস থেকে আয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় বড় সঙ্কট শুরু হয়ে গেছে। যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের নানা কর্তৃপক্ষ সাহস দিয়ে চলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে। গত মার্চের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে খাবার মজুতের কোন প্রয়োজন নেই।  দে‌শে যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে।  তাই অযথা খাদ্য মজুত করে দাম বাড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই।  ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা খাদ্য মজুত কর‌বেন না। জনগণ‌কে কষ্ট দেবেন না। খাদ্য নি‌য়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।” পরিস্থিতি সামাল দিতে ও জনগণের মনোবল ঠিক রাখতে তিনি এসব বললেও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ভবিষ্যতের কালো মেঘের পূর্বাভাস।  তাই প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিটি বক্তব্যে দেশের জমির সুষ্ঠু ব্যবহার থেকে শুরু করে খাদ্য বিষয়ে কোনো না কোনো পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন জনগণের কল্যাণে। মাঝে মাঝে মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদেরও এক হাত নিচ্ছেন।

এবার আসা যাক অমর্ত্য সেনের বাণী ও দেশের খাদ্য পরিস্থিতির বিষয়ে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নানা সূত্রমতে দেশে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে। এছাড়া সরকারের কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় আর আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। সরকারের সবশেষ (২০১৯) অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, দেশে আউসের উৎপাদন ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ২৭ দশমিক ০২ লাখ মেট্রিক টন। আমনের উৎপাদন ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ১৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। বোরো উৎপাদন ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ১৯৬ দশমিক ২৩ লাখ মেট্রিক টন। আর মোটা চাল উৎপাদন ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ৩৬৪ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্রিক টন। গম উৎপাদন ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ১২ দশমিক ৮৭ লাখ মেট্রিক টন। উপরোক্ত ধারা বজায় থাকলে দেশে এবছরও প্রচুর খাদ্য শস্য মজুত থাকবে বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য শস্য কৃষকের কাছ থেকে কেনার ঘোষণা এসেছে। করোনাভাইরাস

সবকিছুইতো তাহলে ঠিক আছে, তাহলে কেনো দুর্ভিক্ষের শঙ্কা? ওই যে ড. অমর্ত্য সেনের বাণী, ‘দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় বণ্টনের অভাবে।’ এখন পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহ ও বন্টনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা কিন্তু দুর্ভিক্ষের পক্ষেই সায় দিচ্ছে।

দেশে কৃষির উৎপাদিত বিভিন্ন শস্য-তরকারি যোগাযোগ ও বিতরণ ব্যবস্থার অভাবে ১ টাকা থেকে ৫ টাকা দামে নেমে এসেছে, ফসল তোলার খরচ উঠবে না বলে অনেকসময় ক্ষেতেই ফসল নষ্ট হচ্ছে বলেও গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। এছাড়া করোনায় জরুরি খাদ্য সহায়তায় ত্রাণ বিতরণে যে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে চরম মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাৎক্ষণিক দণ্ডের পাশাপাশি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তার পরেও থেমে নেই চাল-তেল চুরিকাণ্ড! ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষ খাবার কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটাতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটকে।  ইতিহাসবিদদের দাবি, ওই দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়নি, হয়েছিল খাদ্যসামগ্রীর সুষম বণ্টনের অভাবে।  বিদেশ থেকে প্রচুর খাদ্য আমদানি করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার; কিন্তু চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি চলে গিয়েছিল মাটির তলার গুদামে।  তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম সঙ্কট।  মূলত স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি চক্র ও কিছু রাঘোববোয়ালের সরাসরি যোগসাজশে ওই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলেও শোনা যায়।

৭৪ এর পরিস্থিতি থেকে পাওয়া শিক্ষা আমরা করোনাকালে কাজে লাগাতে পারি।  সরকার চাইলে কিনা পারে, কোন অপকর্ম কীভাবে হয়, কারা করে তা দেশের চৌকষ গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জেনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সময়ের দাবি।  সংকটকালীন এ সময়ে দেশে মজুদকৃত খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো, সুষম বণ্টন, স্বচ্ছতা এবং সহজেই পণ্য কেনার সামর্থ্যতার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।  জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি সরকারে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই হয়তো এই বৈশ্বিক মহামারী সময়ের দুর্যোগ ও ভবিষ্যত দুর্ভিক্ষের শঙ্কা দূর হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)