একাডেমিক ও তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে (State Centered) রাষ্ট্র কেন্দ্রিক তত্ত্বানুযায়ী, রাষ্ট্র বৈষম্য নিরসনের জন্য সকল নাগরিকের জন্য সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। ধর্তব্য নীতির এবং পলিসির মাধ্যমে শোষণ/বঞ্চনা বিলোপে রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে থাকে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিককে সমান সম্মান ও মর্যাদার সহিত মূল্যায়ন করা হয়।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের কারণ ও অন্যান্য অনুসঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের জন্য উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করেছে। যার প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসীরা আইনের মুখোমুখী হচ্ছে এবং আদালত কর্তৃক বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পাচ্ছে, মানি লন্ডারিং ও অর্থায়নের সাথে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করে বিচার করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, শাস্তির ভয়ে নতুন করে ঝোঁক বেঁধে আসা কেউই সন্ত্রাসের মতো ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে না এবং সন্ত্রাসবাদের জন্য উদ্ভূত বেশ কিছু কারণকে নানাভাবে প্রতিকার ও প্রতিরোধের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মকে সন্ত্রাসবাদে নিরুৎসাহী করে তুলেছে সরকার।
ঘটনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ, তদারকি, জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে বর্তমান সরকার সন্ত্রাসবাদের অভিশাপ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রসঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের যে ঐকান্তিক ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে অবস্থান তা যথাযথভাবে কার্যকর করা সম্ভব হলে সন্ত্রাসবাদের মতো কেউই আর দুর্নীতি করতে সাহস পাবে না কিংবা কেউই অনুপ্রেরণা তথা মদদ যোগাবে না। কাজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতি প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্র কেন্দ্রিক তত্ত্ব জোরালোভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্নীতি ইস্যুটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রত্যেকটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিচিতি পেয়েছে। দুর্নীতি যে কোন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। টিআইবির জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৮টি সেবা সহায়তা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৬৬.৬ শতাংশ সেবা গ্রহিতা দুর্নীতির স্বীকার হয়ে থাকেন। দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ এবং বাংলাদেশের প্রত্যেক সমাজেই দুর্নীতির স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে দুর্নীতির ক্রমাগত ধারা বহমান এবং এখন একাডেমিক ডিসকোর্সে দুর্নীতি বিষয়টিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করা হয়।
মিশর, ব্যবলিয়ন এবং হিব্রু সভ্যতায় বিচারকরা ঘুষ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। রোমান সভ্যতায় সরকারি অফিসে নির্বাচনে ঘুষের প্রচলন ছিল। ফ্রান্সে বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত সরকারি অফিসগুলো ঘুষের বিনিময়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতো। সপ্তদশ শতকে বৃটেনে ঘুষের সংস্কৃতি চালু হয়। প্বার্শবর্তী দেশ ভারতের অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দুর্নীতির কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কাজেই, বলা যায় দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং বিশ্বায়নের সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের সমাজে দুর্নীতির রেশ ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য এখনই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সাধারণভাবে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের প্রত্যাশায় ক্ষমতার অপব্যবহারকেই দুর্নীতি বলা হয়। এতে বলা হয়, ঘুষ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, প্রতারণা, জালিয়াতি ইত্যাদি দুর্নীতি হিসেবে পরিগণিত হয়। দুর্নীতি ঐ ব্যক্তিকেই দিয়ে হবে যার রাজনৈতিক পদমর্যাদা, দাপ্তরিক স্ট্যাটাস ও সামাজিক অবস্থান সুসংহত হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ও সংগঠনের সুবিধার্থে অবৈধ কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে।
কাজেই, দুর্নীতির পরিধি ব্যাপক এবং এর সঙ্গে নানাবিধ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিও জড়িত। জবাবদিহীতা ও দায়িত্ববোধের সুস্পষ্ট লঙ্গনের কারণেই স্বাভাবিকভাবে দুর্নীতির ছায়া সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে। দেশপ্রেমের মহিমা ও বিবেকবোধের মেলবন্ধন ব্যতীত দুর্নীতি প্রতিরোধ কখনোই সম্ভব নয়। আবার কখনো উদ্ভূত পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে অনেকেই দুর্নীতি করে থাকে যেমন; পারিবারিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত উৎপীড়নে বাধ্য হয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং দুর্নীতি একটি জটিল ইস্যু এবং এর থেকে উত্তরণে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জবাবদিহীতার চর্চা লালন ও পালন করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দুর্নীতি নিয়ে বেশ সরগরম অবস্থায় চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে সকল পক্ষের লোকজন সাধুবাদ জানিয়েছে এবং অনেকেই আশার আলো দেখছেন। মন্ত্রী পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সরকারের গ্রহণীয় পদক্ষেপের বাস্তবতা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি যে দল থেকেই আসুক না কেন বর্তমান পরিচয়ের ভিত্তিতেই তারা অপরাধ করার সাহস এবং সুযোগ পেয়েছে।
কাজেই, অপরাধী অপরাধীই; তাঁর কোন দলীয় পরিচয় থাকতে পারে না, সন্ত্রাসবাদের ন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কৌশলই দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের সফলতা আসতে পারে। যু্বলীগের সদ্য বহিষ্কৃত নেতা জিসান মাহমুদ ও এসএম গোলাম কিবরিয়া শাহীনের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সদিচ্ছার চিত্র দেখা যায়। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী কমিটি ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দুর্নীতির অভিযোগে অব্যাহতি দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে ৪শ’ পিস ইয়াবা ও প্রায় দশ লাখ টাকা এবং প্রায় ৬ লাখ টাকার ডলার পাওয়া যায় এবং ৩টি অস্ত্র পাওয়া যায় যার মধ্যে একটি অবৈধ।
যুবলীগ নেতা শামীমের গুলশানের নিকেতনের বাসা ও অফিস থেকে মদ, নগদ ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ডলার, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, সাতটি শর্টগান ও একটি পিস্তল ও বুলেট উদ্ধার করে। এই দুজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং এ কার্যক্রম চলমান থাকবে বলেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হচ্ছে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পেলে যে কারোর বিরুদ্ধে সরকারের দুর্নীতি বিরোধী চলমান গ্রেফতার কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আমি হলফ করে বলতে পারি আগামীতে কেউ দুর্নীতি করার পূর্বে অন্তত কয়েকবার চিন্তা ভাবনা করেই দুর্নীতি না করার সিদ্ধান্ত নিবে।
বাংলাদেশে কেন দুর্নীতির ভয়াবহতা প্রকট হচ্ছে তার কার্যকারণ অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি কারণকে মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়।
প্রথমত: দুর্নীতির সুযোগ থাকায় বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত প্রভাবশালীরা তাদের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত লাগামহীনভাবে দুর্নীতি করে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ ও সহজলভ্যতা কমিয়ে আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক বলয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন দল থেকে আসা দলছুটরা ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে পদ পদবী বাগিয়ে নিয়ে নেতাদের নজরে আসার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে দলের নানা কর্মসূচিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের প্রচেষ্টা চালায়।
তৃতীয়ত: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হস্তক্ষেপের অভাবে (রাজনৈতিক পরিচয়, পারিবারিক ইতিহাস, আত্নীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে) দুর্নীতির মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চতুর্থত: রক্ষাকবচের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদক) ভূমিকায় যাদের অবতীর্ণ হওয়ার কথা তাদেরও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততার কারণে দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করছে।
পঞ্চমত: রাজনৈতিক দলে প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির (politicization of criminal) আশ্রয় প্রশ্রয়ের কারণে দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
ষষ্ঠত: চাকুরিতে নিয়োগ, টেন্ডার, ভর্তি প্রক্রিয়া, পদোন্নতি, পদায়ন ইত্যাদি সংক্রান্তে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার অভাবে দুর্নীতির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।
শেষত: স্ব স্ব কর্মস্থলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সদিচ্ছা, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহীতার অভাব থাকায় দুর্নীতির চর্চা থেকেই যায়।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যধি। কাজেই দুর্নীতিকে সমাজ থেকে সমূলে উৎখাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনগণের সাথে পুলিশের আন্ত:সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে; এমন অভিযোগও পাওয়া যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দুর্নীতিবাজদের সখ্য রয়েছে যার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের জ্ঞাত তথ্য পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয় না।
যদি বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয় তাহলে জনগণ সহজেই পুলিশের কাছে তথ্য প্রদান করতে পারে এবং যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতির লাগাম টেনে আনা সম্ভব। খবরে জানা যায়, গডফাদারদের ভয়ে সাধারণ জনগণ সংবাদ মাধ্যমে ও পুলিশের সামনে অপরাধ এবং অপরাধীর প্রকৃত তথ্য গোপন করে রাখে। অবশ্য এর জন্য সরকারকে বেশ কিছু সময়পোযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পুলিশব্যবস্থাকে তথা পুলিশ প্রশাসনকে রিফর্ম করতে হবে এবং জনগণের সামনে পুলিশের ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গুণগতমানসম্পন্ন পুলিশিং এর প্রচলন ঘটাতে হবে।
নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি ও পদায়নকে স্বচ্ছ ও যথার্থ রাখতে হবে। জনগণ ও পুলিশের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও আবেগের জায়গা সুশৃঙ্খল রাখতে হবে তাহলেই গুণগত পুলিশিং এর সংস্কৃতি চালু হবে। এছাড়া রাজনীতিতে অপরাজনীতি, বিরাজনীতিকরণ, সন্ত্রাসবাদে আদিষ্ট এমন কাউকে রাজনীতির সুযোগ দেওয়া যাবে না। সেটা স্পষ্টাক্ষরে বাংলাদেশে প্রচলিত দলগুলোর গঠনতন্ত্র উল্লেখিত নিয়মে অবশ্যই উল্লেখ রয়েছে শুধুমাত্র চর্চার অভাব পরলক্ষিত হয়। স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয়, রাজনীতিতে অপরাধের কোন সুযোগ নেই ঠিক তেমনিভাবে রাজনীতিতে অপরাধীদের কোন জায়গা নেই; এ নিয়মকে অনুসরণ করে চললে বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত হতে পারবে শিগগির।
এমন অনেক রাজনীতিবিদ রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া যায় তাদেরকে রাজনীতি থেকে বয়কট করতে হবে আবার অনেকের পূর্বোক্ত অপরাধের রেকর্ড রয়েছে তাদেরকেও রাজনৈতিক দলে জায়গা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির বিষবাষ্প খুব সহসাই দূরীকরণ করা সম্ভবপর হবে। পরিশেষে আমরা আশা রাখবো সরকার নিরপেক্ষভাবে সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করে জনমনে শান্তি, স্বস্তি ও আশার আলো সঞ্চার করবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)