বাঙালি জাবনে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের শেষ নেই-সীমা নেই। সেই বাল্য কালের গ্রাম জীবন থেকেই দেখে আসছি ধর্মীয় উৎসবের প্রাচুর্য্য। যেমন দুর্গোৎসব, জন্মাষ্টমী উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব, নববর্ষ উৎসব, রথযাত্রা উৎসব, রাসযাত্রা উৎসব, পৌষ উৎসব, ঈদ উৎসব, বৌদ্ধ পূর্ণিমা উৎসব, বড়দিন উৎসবক প্রভৃতি। কিন্তু কখনোই সকল উৎসব সকল মানুষের চিত্তে সমভাবে অনুরণন তুলতে দেখিনি। আবার কোনো কোনোটা তা করতে বিপুল পরিমাণে সফল হয়েছে। এতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ বিরাট সংখ্যায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। এমনই একটি উৎসব দুর্গোৎসব-যা বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে বহু যুগ আগে থেকেই।
দুর্গোৎসব চলে এক সপ্তাহব্যাপী। কিন্তু তার এক মাস আগে থেকেই, অন্তত বাল্যকালে গ্রামে বাস করেও যা দেখেছি বাড়ি বাড়ী শুরু হয়ে যেতো নানাবিধ কর্মকাণ্ড। সর্বাধিক পরিশ্রম করতে দেখেছি মাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সকলের জন্য প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করে এবং সবার খাওয়ার শেষে নিজে সামান্য কিছু খাবার মুখে গুঁজে দিয়েই বসতেন খই-মুড়ি ভাজতে, নারকেল কোড়াতে।
বাবা তার রসদ সামগ্রী যেমন খই এর ধান, মুড়ির চাল, নারকেল, গুড়, চিনি, চিড়া প্রভৃতি কিনে আনতেন। প্রয়োজনে মা ডেকে আনতেন পাড়ার কোনো কোনো মহিলাকে যারা ঐ কাজে মাকে সহযোগিতা করতেন। তৈরি হতো খই এর মুড়ী ও চিড়ার মোয়া, নারকেল ও তিলের নারু, তকতি প্রভৃতি।
আর আমরা শিশুরা? ধুম পড়ে যেতো এসব খাওয়ার। মা নিজে থেকে প্রচুর দিতেন। তবুও আবার মাঝে মধ্যে মা-বাবার অসাক্ষাতে চুরি করেও খেয়ে নিয়ে সাধু সেজে পড়তে বসতাম। দুর্গোৎসব মানে দুর্গাপূজা ও আনুষঙ্গিক আরও অনেক কিছু। তারই একটি অংশের কথা একটু আগেই উল্লেখ করলাম।
পূজা কিন্তু বাড়ী-বাড়ী হতো না-আজও হয় না। নানা মন্দিরে সার্বজনীন ভিত্তিতে চাঁদা তুলে হতো এবং আজও হয় পূজার আয়োজন। কিন্তু পূজার ধুম বাড়ি বাড়ি, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে সর্বত্র।
সবার জন্য নতুন পোষাকের ব্যবস্থায় কী যে আনন্দ হতো তখন। আজকের মতো তৈরি জামা প্যান্টের আমদানি তখন বেশী একটা চোখে পড়তো না। দর্জিদের উপর দায়িত্ব পড়তো পোষাক বানানোর। সে কী যে ব্যস্ততা তাদের। দর্জির দোকানে গিয়ে শার্ট-প্যান্টের মাপ দিয়ে আসার আনন্দই ছিল আলাদা। আর তৈরির পর যেদিন নতুন জামা প্যান্ট জুতা ইত্যাদি পেতাম-তখনকার আনন্দ আজ আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তখনকার দিনে আরও একটি মজার বিষয় ছিলো। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বাড়ি একটা ছোট খাটো মিলনমেলায় পরিণত হতো। কলকাতা, দিনাজপুর, জামালপুর, দাঁড়ামুদা প্রভৃতি নিকট ও দূর থেকে চলে আসতেন অনেক আত্মীয়-স্বজন। যেহেতু আমরা ভাই-বোনেরা ছিলাম অনেক ছোট তাই ছুটে যেতাম ঐ গুরুজনদেরকে প্রণাম করতে। প্রণামের মধ্যে যেমন নিহিত থাকতো শ্রদ্ধা জানানো তেমনই আবার তাতে প্রাপ্তিযোগও কম ছিল না। গুরু জনেরা সবাই পোষাক বা অন্যান্য আকর্ষণীয় উপহার নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। প্রণামের বদলে তাই প্রাপ্তিযোগটাও কম ছিল না।
প্রতিমা নির্মাণ হতো মন্দিরে মন্দিরে। কখনও কোন বৃহদায়তন ঘর খালি পাওয়া গেলে প্রতিমা নির্মাণ শিল্পীরা (যাঁরা ‘পাল’ বলে পরিচিত) সকালে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকগুলো প্রতিমা নির্মাণ করতেন পূজারী ভক্তদের অর্ডার মোতাবেক। সেখানে প্রতিযোগিতা চলতো কোন মন্দিরের জন্য কত বড় প্রতিমা নির্মাণ হবে, কোন মন্দিরের প্রতিমার অঙ্গ মৌষ্ঠব কত বিচিত্র ধরণের হবে ইত্যাদি নিয়ে। পালদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলতো কে কত সুন্দর-কত বেশী দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা নির্মাণ করতে পারেন। প্রতিযোগিতায় সাফল্যের জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থাও থাকতো।
আমরা তরুণ-তরুণীরা নানাভাবে আনন্দে মেতে উঠতাম। একদিকে পোষাকের বৈত্রিত্য, অপরদিকে নানা মন্দিরে দল বেঁধে প্রতিমা দর্শনের ভিড়ে মেতে ওঠা। শুধুমাত্র নিজ গ্রামের প্রতিমাগুলোই নয় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো এবং এমনকি শহরেও অন্তত একদিন গিয়ে পূজা দেখা, আরতি-নৃত্য দেখা, প্রসাদ ভক্ষণ ইত্যাদির ধুম পড়ে যেতো। বহু মন্দিরে নাচ-গানের আসরও বসে যেতো। দুর্গোৎসবের আরতি ছিল বৈচিত্র্যময় এবং শৈল্পিক মাধুর্য্যে ভরপুর। এক্ষেত্রেও নৃত্য শিল্পীদের পরস্পরের মধ্যে চলতো প্রতিযোগিতা। আর দর্শকের ভীড় বেড়ে যেতো আরতি-নৃত্য দেখার জন্য। সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দুরুহ।
নানা বয়সের মেয়েরা, বিবাহিত বা অবিবাহিত, পূজার অন্তত তিন দিন- মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমীর রাতে নতুন শাড়ী বা নিজ নিজ পছন্দের নতুন নতুন পোশাক-গহনাদি পরে বের হতেন দল ধরে, পূজা দেখতেন ঘুরতেন এক মন্দির থেকে অপর মন্দিরে। প্রতিমা দেখার সুবাদে ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘদিন দেখা সাক্ষাৎ না হওয়া বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ঊষ্ণ আলিঙ্গন-কুশল বিনিময় করতেন, সেই সঙ্গে চলতো নানা ভবিষ্যৎ কর্মসূচি স্থির। অর্থাৎ পরদিন কারা কারা দিনের বেলায় কোথায় কোথায় ঘুরবেন-সন্ধ্যায় কোথায় কোথায় প্রতিমা দর্শনের বের হবেন ইত্যাদি। দীর্ঘদিনের সাক্ষাৎ না হওয়ার শূন্যতা দিন কয়েকের জন্য পূরণ হলে যে আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকতো না-তা ঐ দিনগুলোতেই বিশেষভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হতো। তেমনি পূজার লম্বা ছুটি শেষে যার যার স্থানে ফিরে যাওয়ার বিচ্ছেদ-বেদনাও কম ছিল না।
পূজা উপলক্ষ্যে নতুন বিয়ে হওয়া মেয়ে-জামাইরা আসতেন বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি। এ নিয়ে বাড়ির কর্তা-গৃহিনীর পরিশ্রমের অন্ত থাকতো না। জামাইকে কেমন নতুন পোশাক উপহার দেবেন মেয়েকে নতুন শাড়ী গহনা-জামাইভোজ ইত্যাদি যেন উৎসবের মধ্যে আর এক উৎসব। অনেক বাড়িতেই এ উপলক্ষ্যে হতো বাড়তি আয়োজন, বাড়তি আনন্দের সমারোহ। স্বর্ণকাররা এই দিনগুলোতে বছরের ব্যবসার প্রধান অংশই সম্পন্ন করতে উঠে পড়ে লাগতেন। সাধ্য অনুযায়ী প্রতিটি হিন্দু পরিবারের মেয়েদের পূজার উপহারের তালিকায় গহনার স্থান থাকতো অনেকটা যেন বাধ্যতামূলক-বিশেষ করে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে। মা-বাবার কাছে মেয়েরা হতো বেশী আদরের (যেহেতু বড় হয়ে তারা তারা অন্য ঘরে চলে যাবে) তাই তাদের আবদার ছিল বিশেষভাবে অগ্রগণ্য। ফলে স্বর্ণকারদের বিশেষ ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। দিবারাত্র খোলা থাকতো সুসজ্জিত গহনা দোকানগুলো। বাদ্য-বাজনার ধুম, তাদের বাদন প্রতিযোগিতা মন্দিরগুলোতে এক অপূর্ব আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তুলতো। তাদেরও প্রতিযোগিতা হতো। ঢাক, ঢোল-সানাই, খোল, করতাল, ঠুংরীসহ নানা বাদ্যযন্ত্র ঝংকার তুলতো মন্দিরে মন্দিরে। আর তারই তালে তালে নৃত্য-আরতি নৃত্য। একই সাথে ধূপের ধোঁয়ার সুগন্ধে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠতো। তেমনি পূজার কয়দিনই বিশেষ করে মহাষ্টমী ও সন্ধি পূজার লগ্নে দলে দলে নারী-পুরুষ নানা মন্দির প্রাঙ্গণে মিলিত হতেন দুর্গাদেবীর প্রতি অঞ্জলি দেওয়ার জন্য- সাধারণত সকাল বেলায়। মন্দিরে আসার আগে স্নান সেরে নতুন কাপড় পড়ে সেজেগুজে সবাই এসে সমবেত হতেন। এই লগ্নে কেউ কেউ ভোগও দিতেন। অনেকে তাদের মানত অনুযায়ী দুর্গার উদ্দেশ্যে ভোগ বা বলি প্রভৃতিরও আয়োজন করতেন।
এর সাথে চলতো মেলার ধুম। প্রতিটি মন্দিরের আশপাশ দিয়ে অথবা নির্ধারিত কোন মাঠে আয়োজন করা হতো সাত দিনব্যাপী মেলার। মেলায় সাধারণত খেলনা, কাঠের বেলনা, চালুন, পিঁড়ি, বটি, দা, কাচি, খৈ, মুড়ি, মুড়কি জিলাপি, সন্দেশ, রসগোল্লাসহ নানাবিধ মিষ্টান্নের পসরা সাজিয়ে বসতেন হিন্দু- মুসলিম ব্যবসায়ীরা। বিজয়া দশমীতে বিষাদের বেদনা যেন সবাই মাতৃহারা হয়ে পড়ছেন। “তবু যেতে দিতে হয়”-তাই নদীতে প্রতিমা বিসর্জন। বিসর্জন উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয় নৌকাবাইচ, মেলা প্রভৃতি।
পরদিন সকালে বাড়ি বাড়ি প্রণাম আলিঙ্গন, মিষ্টি মুখের ধুম পড়ে যেতো। এরপর আয়োজিত হতো বিজয়া প্রীতি সম্মীলনী। এ উপলক্ষ্যে সুন্দর সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অতঃপর সকল কিছুর সমাপ্তি। পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা।
পূজা নিয়ে দুর্ঘটনা? না-তা সেই আমলে আদৌ দেখিনি। শুনিনি একটিও মন্দির বা প্রতিমা ভাংচুরের কাহিনী কোন নারী অপহরণ প্রভৃতি কলংকের কথা। উৎসবটি হতো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির মিলনোৎসবের নিদর্শন হিসেবে। বহু মুসলিম মুরুব্বী পূজা অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা দিতেন, মুসলিম ছেলে-মেয়েরা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে প্রতিমা দর্শনও করতেন।
তখন আজকের মতো যেমন প্রতিমা বা মন্দির ভাংচুর হতো না, ঘটতো না কোন সগ্রামী ঘটনাও। তেমনই আবার দুর্গোৎসব বা কোন কোন ধর্মীয় উৎসবের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ র্যাব প্রভৃতির পাহাড়াও বসাতে হতো না। উৎসবগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হতো।
দুঃখজনক যে আজ আর সেই ধারা অব্যাহত নেই। এখন দুর্গোৎসব, জন্মাষ্টমীর মিছিল, দুই ঈদের জামাত, মহররমের মিছিল সবকিছুরই নিরাপত্তা বিধানে হাজার হাজার পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি সদস্য নিয়োগ করতে হয়, টহলের ব্যবস্থা করতে হয়, তবুও পুরোপুরি নিরাপত্তা বিধান হয় না-থামে না সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। তবে কি আমরা দিন দিন সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়ছি? মন্দির বাড়ছে, মাদরাসা বাড়ছে, মসজিদ বাড়ছে, ধর্মীয় শিক্ষা বাড়ছে। রাষ্ট্রধর্মের বিধান করা হচ্ছে, শিক্ষায় প্রসার ঘটছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে কেন? কীভাবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)