নেত্রকোণায় বাল্যবিয়ের অভিযোগে দুই শিশুকে সাজা দেওয়ার ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাজিয়া সুলতানার ব্যাখ্যা আগামি ২৬ আগস্টের মধ্যে হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়া ওই দুই শিশুর মুক্তি চেয়ে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনিরের দেয়া চিঠি রিট হিসেবে গৃহীত হয়ে শুনানির জন্য এলে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। আর আইনি সহায়তাকারী সংস্থা ব্লাস্টের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী এস এম রেজাউল করিম।
আজ শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুলতানা রাজিয়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ভুল ধারণার ভিত্তিতে এটি প্রয়োগ করেছেন বলে আমার ধারণা। তাই বিষয়টি এখানেই শেষ করা সমীচীন হবে না। কর্তৃপক্ষ (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) উনাকে কারণ দর্শাতে বলেছেন। উনি কী কারণ দর্শান তার কপি এই আদালতে দাখিলের আরজি জানাচ্ছি। কেননা, কোন ধারণা থেকে তিনি এটি করেছেন, তা দেখা দরকার।’
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘নিউজে যতটুকু পড়েছি, তাতে দেখা যায় যে ওই সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুলতানা রাজিয়া তার চেম্বারে বসে সাজার আদেশ দিয়েছেন, এটা কি ভ্রাম্যমাণ আদালত করতে পারে?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি স্পটে করতে হবে, চেম্বারে করতে পারবেন না।’ তখন হাইকোর্ট বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত হচ্ছে অন দ্য স্পট। স্পটে করতে হবে অন অ্যাডমিশন। এটি চেম্বারে বসে করার সুযোগ নেই, থানায় বসে করার সুযোগ নেই। শুধু এই ঘটনার (দুই শিশু) ক্ষেত্রেই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এবং আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি যে, হয়তো কোন ঘটনা ঘটেছে, তা হয়তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ঘটনার দু-তিন দিন পর গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দিচ্ছেন।’
একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘এগুলো সরকারি পর্যায়ে বলবেন যখন ম্যাজিস্ট্রটদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত কীভাবে পরিচালিত হবে এবং কীভাবে চর্চা করবে। কারন, এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর প্রশিক্ষণেরও দরকার আছে। এমন অনেক ঘটনা গত কয়েক মাসে দেখেছি পত্রিকায় এজন্য নজরে আনলাম।’ এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, ‘আমি কথা বলব।’ এবিষয়ে শুনানি শেষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাজিয়ার দেওয়া ব্যাখ্যার কপি আগামি ২৬ আগস্টের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
নেত্রকোনার দুই শিশুকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর খবর যুক্ত করে তাদের মুক্তি চেয়ে বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বরাবর ই-মেইলে একটি চিঠি (পত্র) পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এর কয়েক ঘন্টা পরে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, ‘দুই শিশুর সাজার খবরটি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনা হলে আদালত ওই দুই শিশুর মুক্তির বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে আমাকে তা নেত্রকোনার ডিসিকে অবহিত করতে বলেন। আমি নেত্রকোনার ডিসিকে আদালতের আদেশটি টেলিফোনে অবগত করি। তখন তিনি (ডিসি) জানান ইতোমধ্যেই শিশুদের আপিল শুনানি করে তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে।’
দুই শিশুকে নিয়ে প্রথম আলোর করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে দুই শিশুকে এক মাসের দণ্ডাদেশ দিয়েছেন নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুলতানা রাজিয়া। গত রোববার রাতে আটপাড়ায় সুলতানা রাজিয়া তার নিজ কার্যালয়ে এই দণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে শিশু দুটিকে গাজীপুরে অবস্থিত শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক-বালিকা) পাঠানোর নির্দেশ দেন। শিশু দুটি মঙ্গলবার পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলা কারাগারে ছিল।’
পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদন যুক্ত করে শিশুদের মুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে পাঠানো পত্রে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির লেখেন, ‘এই রিপোর্ট পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী শিশু আইনের অধীন মোবাইল কোর্টের কোনো এখতিয়ার নেই। ফলে, অত্র সাজা এখতিয়ার বহির্ভূত। সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী তার পত্রে আরও লিখেন যে, ‘আমার মনে আছে, ফতোয়ার মামলায় পত্রিকার রিপোর্ট দরখাস্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। ছাত্রজীবনে পড়েছি, একটি টেলিফোন কল নাকি এফআইআর হিসেবে গণ্য হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রধান বিচারপতি বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিলেন এক সন্তানহারা মা নীলাবতি বেহারা। সেই চিঠির ভিত্তিতে তিনি ক্ষতিপূরণও পেয়েছিলেন। স্বচক্ষে দেখেছি, পত্রিকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনেক স্বপ্রণোদিত রুল জারি হয়েছে। বিচারও হয়েছে। জেল থেকে পাঠানো চিঠিগুলো জেল আপিল হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব উদাহরণ দেখে কিছুটা অতি উৎসাহী হয়ে এই পত্র লিখলাম। আশা করি, আমার এই পত্র বৃথা যাবে না।’