কুমিল্লার দাউদকান্দির বারেক হাজী মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন। প্রবাস জীবনে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও আয়ত্ত করেন নানা প্রতারণার কৌশল।
দুই বছর পর দেশে ফিরে সকল কাজ বাদ দিয়ে হয়ে যান পুরোদস্তর প্রতারক। প্রতারণার কাজে তার তীক্ষ্ণ দক্ষতা, সুচিন্তিত কর্ম কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা অল্প দিনের মধ্যে তাকে ‘বিরাট সাফল্য’ এনে দেয়।
রাজধানীসহ ক্রমান্বয়ে প্রতারণার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে ৪৩ বছর ধরে প্রতারণার মাধ্যমে বারেক হাজী হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত শত কোটি টাকা।
তবে এই প্রতারক চক্রের মূল হোতা এবার ধরা পড়েছেন র্যাবের জালে। শনিবার রাতে রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে বারেক হাজীসহ ৫ জনকে আটক করেছে র্যাব-৪।
এসময় বারেক হাজীর কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন ও ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
আটক হওয়া অন্যরা হলেন- হাবিবুর রহমান (২৪), জাকির হোসেন (৫৮), মো. আক্তারুজ্জামান (২৮), শাহরিয়ার তাসিম (১৯)।
গত ২ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চক্রের ২২ সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মূলহোতাসহ ৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির।
তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্ম নেওয়া বারেক হাজী প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পার হতে পারেননি। ভাগ্য পরিবর্তনে ১৮ বছর বয়সে সৌদি আরব পাড়ি জমালেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। বরং প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করে মাত্র দুই পর দেশে ফের আসেন তিনি। এরপর সুনির্দিষ্ট কোন পেশায় জড়িত না হয়ে শুরু করেন প্রতারণা। কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতারণাই হয়ে উঠে তার পেশা।
প্রতারণার জীবনে কখনো বারেক হাজী গ্রেপ্তার হননি জানিয়ে র্যাব-৪ সিও বলেন: ৪৩ বছরে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতারণার মাধ্যম অন্তত শত কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপার্জন করেছেন। এছাড়া, ঢাকা শহরে নিজের নামে ফ্ল্যাট, গাড়ি, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে জমি-জমাসহ অঢেল সম্পত্তি মালিক হয়েছেন প্রতারক সম্রাট বারেক হাজী।
বারেক হাজী তার প্রতারণা কোম্পানির নাম দেন আরসিডি। যার প্রকৃত রূপ রয়্যাল চিটার ডেভেলপমেন্ট। এ নামে অফিস নেওয়াসহ সকল কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও প্রকৃত নামটি ছিলো সকলের অজানা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরসিডির ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। যারা সুসজ্জিত অফিস ভাড়া করে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
তিনি বলেন, বারেক হাজীর চক্র ছোট-খাট অঙ্কের প্রতারণা করে না, ন্যূনতম ১০-৫০ লাখ টাকার প্রতারণা করত চক্রটি। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবসরের আগে থেকেই টার্গেট করে।
এরপর তাদের কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অফিসে নিয়ে আসে এবং প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অফিস কর্মকর্তাদের চালচলনে অভিভূত হয়ে টার্গেট করে ব্যক্তিরা অবসরকালীন প্রাপ্ত পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করতেন। যার কয়েকদিন পরেই অফিসসহ উধাও হয়ে যেতেন অফিসের কর্মকর্তারাও।
দেশের বিভিন্ন এলাকার তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদেরকে কয়েক কোটি টাকার অর্ডারের ফাঁদে ফেলে ৪০-৫০ হাজার টাকার স্যাম্পল নিতেন। কয়েক কোটি টাকার মালামাল তৈরীতে যে পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োজন (সুতা, রং ইত্যাদি) তা সরবরাহের কথা বলে অগ্রিম হিসেবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করে আসছিলো চক্রটি।
অতিরিক্ত ডিআইজি আরো বলেন: দেশের বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের জমি বা নির্মাণাধীন ভবনের উপর ইন্টারনেট টাওয়ার স্থাপনের প্রলোভন দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। কখনো বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের বাসায় এবং তার এলাকার মাদ্রাসা, মসজিদে এনজিও’র পক্ষ থেকে বিনা খরচে সৌর প্যানেল বসানোর কথা বলে মোটা টাকা হাতিয়ে নিতো।
এর বাইরে ইট/পাথর, রড/সিমেন্ট, গার্মেন্টস, চাল, থাই/এ্যালুমিনিয়াম, সোলার প্যানেল ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের টার্গেট বানিয়ে তাদেরকে বিপুল পরিমান অর্থের অর্ডারের ফাঁদে ফেলে এবং অর্ডারের ভুয়া চুক্তিপত্র সম্পন্ন করে অগ্রিম বাবদ টাকা আদায় করে প্রতারণা করে আসছিলো চক্রটি।