করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত লকডাউন অব্যাহত থাকবে ২৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার) থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বন্ধ হলো জলপথে নৌযান৷ কার্যত গণপরিবহনে এটি একধরণের লকডাউন৷ এই লকডাউনটি কেন আগে বিমান কর্তৃপক্ষ করল না? ইতোমধ্যে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র এক আতঙ্ক সৃষ্টি করে ফেলেছে বিদেশ ফেরতরা৷ বিমান কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে এমনটি ঘটতে পারত না নিশ্চয়ই৷ সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন পর্যন্ত করতে হল৷ কেন এই সেনা মোতায়েন কি আগে এয়ারপোর্টে করা যেত না৷ প্রত্যেক দেশেই বিদেশী দূতাবাস রয়েছে৷ মানে যে দেশ হতে প্রবাসীরা এলো সেই দেশের সাথে সমন্বয় করে কি বাংলাদেশ তথ্য নিশ্চিত হয়ে বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে পারত না?
কমিউনিটি পর্যায়েও সংক্রমণ শুরু হয়েছে৷ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে চলেছে। দেশে প্রথম তিনজন রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। শুরুতে বিদেশফেরত ও তাদের স্বজনদের মধ্যে এই সংক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল। রাজধানীর মিরপুরে একজনের মৃত্যুর পর সংশ্নিষ্টরা ধারণা করছেন, ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। কারণ মিরপুরে মৃত ব্যক্তি বিদেশফেরত ছিলেন না কিংবা তার কোনো স্বজনও বিদেশ থেকে ফেরেননি। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকায় হাসপাতালের এক চিকিৎসকও আক্রান্ত হয়েছেন। এ থেকে বলা যায়, রোগটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ দেশের জন্য ‘পিকটাইম’ বলে মনে করছেন ভাইরোলজি (জীবাণু) বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ভাইরাসটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা । তবে কি বাংলাদেশ এক মহাদুর্যোগের অপেক্ষায়?
করোনা ভাইরাস থেকে সৃষ্ট মহামারির গতি ক্রমশ বাড়ছে বলে হুঁশিয়ার করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তারা বলেছে এ পর্যন্ত বিশ্বের সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি থেকে শুরু করে এই সংখ্যা এক লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন। পরের ১১ দিনে আরও এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়, আর পরের এক লাখে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র চারদিন। এখন বিশ্বে ৩ লাখ ৮১ হাজার মানুষ প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশ কি এমনই সংক্রমণের গতির দিকে? গণপরিবহন লকডাউন হল৷ বাস, সিএনজি অটো রিক্সা সব বন্ধ হয়ে গেল৷ বাড়ি ঘর লকডাউন না করে গণপরিবহন লকডাউন কেন? মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে৷ সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য মাঠে নামলো সেনাবাহিনী৷ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লকডাউন দিয়ে দিলে কি আরও বেশি ভাল হত না?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও এর ব্যাপকতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করেছে। একজনের দেহেও শনাক্ত না হলে সেই দেশ স্তর-১-এ থাকবে। বিদেশফেরত ব্যক্তির শনাক্ত ও তাদের মাধ্যমে আরও দু-একজনের দেহে সংক্রমিত হওয়া দেশ স্তর-২-এ থাকবে। নির্দিষ্ট কিছু এলাকার বা নির্দিষ্ট কিছু মানুষ সংক্রমিত হলে তা স্তর-৩-এ থাকবে। আর সংক্রমণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে তা স্তর-৪-এর আওতায় পড়বে। বাংলাদেশ কোন স্তরে? আতঙ্কতো দেশব্যাপী৷ প্রতি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নে বিদেশ ফেরতদের তালিকা করা হচ্ছে৷ প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে প্রতি এলাকায় হোম কোয়ারেন্টাইনের৷ এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে আগে কেন ঠেকিয়ে রাখা গেলো না? করোনা আতঙ্কে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা৷ বাতিল হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট৷ স্থগিত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল৷ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে , ওষুধ, মুদি দোকান, কাঁচাবাজারসহ নিত্যপণ্যের দোকানপাট সব৷ বন্ধ হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল। বন্ধ হচ্ছে সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত৷ এবার সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলো মাদক, সন্ত্রাস কিংবা অপরাধ নির্মূলের জন্য নয় সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির জন্য৷ তবে কেন দূরত্বকে দূরে থাকতে দেয়া হল না?
করোনা আতঙ্ক আজ বৈশ্বিক সমস্যা৷ দেশ হতে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে এই জীবনঘাতী ভাইরাস৷ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এই লকডাউন ভারতবাসীকে রক্ষা করার জন্য। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে প্রতিটি ভারতীয়, প্রতিটি পরিবারের জন্য। কেউ বাড়ি থেকে বের হবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন; এতে হয়তো ভারত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিন্তু দেশের মানুষের সুরক্ষার জন্য এটাই এখন করণীয়। করোনা সংক্রমণের শৃঙ্খলা ভাঙতে হলে ২১ দিনের লকডাউন আবশ্যক। যদি আমরা এই ২১ দিনকে ম্যানেজ করতে না পারি, তাহলে দেশ ২১ বছর পিছিয়ে যাবে। অনেক পরিবার চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে৷
করোনা ভাইরাসের কারণে তিন সপ্তাহের জন্য যুক্তরাজ্যকেও লকডাউন করা হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা ভাইরাসকে দশকের ‘বৃহত্তম হুমকি’ উল্লেখ করে লক ডাউনের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ কি করল? সময় থাকতে বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরতদের দেশময় ছড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে কেন কোন ব্যবস্থা নিতে পারলো না? তাদের ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনই নিশ্চিত করতে পারলো না? বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ কি সময়ের দাবি ছিলো না? অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তিনমাস আগে হতেই আমাদের প্রস্তুতি ছিল৷ কিন্তু এ প্রস্তুতির কি কোন ফল পেতে পারলো মানুষ?
করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ কি প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা রাখে?মন্ত্রীদের অতিকথন কি হাস্যকর মনে হচ্ছে না৷ কেউ বলছেন আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী৷ কেউ বলছে আমেরিকাও করোনার ব্যাপারে আমাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা চেয়েছে৷ সরকারী ছুটি ঘটনায় কী ঘটছে? অনেকেই ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাচ্ছে৷ ইতোমধ্যে অনেকের প্রমোদ ভ্রমণের খবরও আমরা পেয়েছি৷ বিদেশ হতে দেশে আসা যদি অপরাধ হয় তবে করোনা আতঙ্কে ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া কেন অপরাধ নয়? প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মস্থলে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বাধ্য করা হোক৷ করোনা আতঙ্কের ছুটিতে যারা গণপরিবহনে যাচ্ছে ও কর্মস্থল ত্যাগ করেছে বিদেশ ফেরতদের মতো তাদেরও তালিকা করা হোক৷ তারা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির সরকারি নির্দেশনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে৷ নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে কি হল? মন্ত্রিসভার বৈঠকেও মন্ত্রীরা করোনা সতর্কতায় দূরত্ব বজায় রেখে বসলো৷ আর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলন করে৷ অথচ সময় থাকতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো৷ প্রায় ৬ লাখ বিদেশ ফেরত দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে৷ বিমান কর্তৃপক্ষেরই কি এর দায় নয়?এই দায়হীন ও বোধহীন মনোবৃত্তি কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশটিকে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)