মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখবেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য। পর্ব-১ (ডিসেম্বর ১, ২০১৬)
এক.
আমার এক ডাক্তার বন্ধু মনে করেন দারিদ্র্য কমলেই মানুষ সুখে থাকে। জীবনের হতাশা কেটে যায়। আর তাই দেশের মানুষের কল্যাণের প্রশ্ন এলেই বন্ধুটি দেশের দারিদ্রের সর্বশেষ খবর জানতে চান। তিনি খুব খুশি বাংলাদেশের দারিদ্র্য অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তিনি সরকারি মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। প্রাইভেট চেম্বার করেন। চেম্বারে তার ভিজিট হলো ১০০০ টাকা। অন্যদিকে মাসে ১,৩০০ টাকার কম আয় করলে তাকে চরম দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। তার সহজ মানেটা হলো একজন চরম দরিদ্র রোগী কখনোই তার কাছ থেকে চেম্বারে গিয়ে পরামর্শ নিতে পারবে না, আর পারলেও তার পক্ষে প্রেসক্রিপশনে দেওয়া ওষুধ কেনার পয়সা থাকবে না। বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হলো প্রায় ২ কোটি। বা মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণে ব্যয়িত অর্থকে বিবেচনা করে দারিদ্র্য নিরূপণ করে। সরকারি হিসেবে মাথাপিছু দৈনিক ২,১২২ ক্যালরির কম গ্রহণ হলে তাকে দরিদ্র হিসেবে গণ্য করতে হবে। আর দিনে ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির কম খাদ্য কেনার মতো আয় হলে তাকে চরম দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকারি হিসেবে ১,৩০০ টাকার কম আয় মানে ওই ব্যক্তির পক্ষে ন্যুনতম ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির খাদ্য কেনার মতো আয় নেই।
দুই.
এদিকে, বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের মানুষের দারিদ্রমুক্ত থাকাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- “রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।” অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের উপর মানুষের শোষণ হতে ন্যায়নুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভের কথা বলা হয়েছে, যার মূল কথা হলো দারিদ্রমুক্ত সমাজ। সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির মধ্যে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষকে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দেওয়া। এবং মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সংবিধানে আরো বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাতে নাগরিকদের পক্ষে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল দেশের জন্য প্রাণ দানকারী ৩০ লাখ শহীদ।
তিন.
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বাংলাদেশের ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই ছিলেন দরিদ্র মানুষ। ২০১৬ সালে এসে সেই চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এবছর প্রকাশিত সরকারি হিসেব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৩.৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। তারমানে ৪৫ বছরে বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে ৪৮ জন। এটিকে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী অর্জন বলা চলে। কিন্তু এই অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬ কোটি ৬৪ লাখ, যা ১০ কোটি বেড়ে ২০১৬ সালের নভেম্বরে হয়েছে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ (সূত্র: http://www.worldometers.info/world-population/bangladesh-population/ )। যেকারণে প্রতি ১০০ জনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪৮ জন কমলেও মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭১ সালের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৭১ লাখের জায়গায় এখন হয়েছে ৩ কোটি ৮৪ লাখ; যার মধ্যে ৫২ শতাংশ হলো চরম দরিদ্র।
চার.
সরকারি হিসেবের সঙ্গে বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাস নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসেবে পার্থক্য রয়েছে। এমনকি পদ্ধতি নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের ভিত্তিতে দেশের দারিদ্র্য হার নির্ণয়কে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের দারিদ্রের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য সঠিক পদ্ধতি বলে মনে করে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতির পরিবর্তে এমপিআই সূচক ব্যবহার করে দারিদ্র্য পরিমাপ করার পক্ষপাতি যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানের অধীনে ১০টি নির্দেশক ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পুষ্টি ও শিশু মৃত্যু; জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে রান্নার জ্বালানী, টয়লেট, পানি, বিদ্যুৎ, আবাসস্থলের মেঝে কাঁচা বা পাকা, ইত্যাদি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই দশটি সূচকের ভিত্তিতে দারিদ্র্য নিরূপণ করা হলে সেটি আমাদের সংবিধানের মৌলিক নীতির সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। অক্সফোর্ডের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্রের হার ৫১ শতাংশের বেশি। যার মধ্যে চরম দরিদ্র মানুষই হলো প্রায় ২২ শতাংশ। অক্সফোর্ডের চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সরকারের মোট দারিদ্রের প্রায় সমান। (http://hdr.undp.org/en/content/multidimensional-poverty-index-mpi)
পাঁচ.
মূলত দারিদ্র মাপার বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি এবং মাপকাঠির চলতি ও পুরনো ভিত্তি দারিদ্রের হারের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। যেমন, বিশ্ব ব্যাংক একসময় দিনে ১ ডলার ২৫ সেন্টের নিচে আয় করলে তাকে চরম দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করত। এখন সেটাকে বলছে ১ ডলার ৯০ সেন্ট। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী দারিদ্র্য নিরূপণ করে থাকে। দারিদ্র নিরূপণের আরেকটি সূত্র হলো মাথাপিছু দৈনিক ক্যালরি গ্রহণ, যা বাংলাদেশ সরকার অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি চালু করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যা আবার দ্রুত সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে তার মানবিক চেহারা থাকার কারণে। বাংলাদেশ সরকারের হিসেব করার যে পদ্ধতি তাতে আয় দারিদ্র্য বোঝা গেলেও আয় বৈষম্য বোঝা যায় না। সংবিধানে যে শোষণমুক্ত রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে সেটি এখানে অনুপস্থিত থেকে যায়।
ছয়.
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনীতিবিদ মি. আবুল বারাকাত এক তথ্য দিয়েছেন দরিদ্র মানুষ নিয়ে, তার মতে বাংলাদেশের ১০ কোটি ৫৫ লাখ দরিদ্র মানুষ। যা মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ। তিনি এই ধরনের তথ্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে দারিদ্র হ্রাসে বাংলাদেশের বিষ্ময়কর অগ্রগতিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন।
এই অবস্থায় সরকারের দিক থেকে দারিদ্র্য নিরূপণে একটি সর্বজনগ্রাহ্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যেখানে সংবিধানে দেওয়া নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের বিষয়গুলো দারিদ্র্য নিরূপণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় করা হবে। কারণ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও শোষণের কারণে দারিদ্র কিংবা দেশে গরিবের শোষণ বহাল থাকাটা কাম্য হতে পারে না। সংবিধানের অধিকার প্রত্যেক নাগরিককে পৌঁছে দিতে পারে এমন মানদণ্ড দ্বারাই এখন দারিদ্র মাপা দরকার। নতুবা আমরা সবসময় একটা গোলকধাঁধাঁয় আটকে থাকব। একদিকে দেশের দারিদ্র্য কমার তথ্য পাবো অন্যদিকে ১০ টাকা কেজি ধরে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে চাল দিতে হবে, যেখানে দেশের মোট পরিবারের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এখন আমাদের দরকার সত্যিকারের বিষ্ময়কর অর্জন, যা দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে প্রতিটি নাগরিকের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)