‘দশ বছর ধরে বাচ্চা ও বন্দুক দেখানো ছাড়া আমি ফিল্ম বানিয়ে যাচ্ছি’
চার পর্বের সাক্ষাৎকার-এর দ্বিতীয় পর্ব:
রবিবার। ১০ নভেম্বর। বিকেল। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সারা বাংলাদেশের মতো ঢাকার আবহাওয়াও কিছুটা গোমট। মেঘলা। কখনোবা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি! এসব তোয়াক্কা না করে বনানীর যাত্রা বিরতিতে হাজির আমরা কয়েকজন। কারণ বিকাল ৫টায় মুখোমুখি হওয়ার কথা এমন এক মানুষের সাথে, যাকে ভারতবর্ষ ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’ পরিচালক হিসেবে জানে! যিনি এই সময়কে চিহ্নিত করছেন ‘আবর্জনার যুগ’ হিসেবে। পৃথিবীতে ঘটে চলা সমস্ত কিছুর জন্য প্রকাশ্যে মানুষকে কাঠগড়ায় তুলে দেন তিনি। নির্দয়ভাবে যিনি বলে দিতে পারেন, ‘পৃথিবীতে আর একটি শিশুর জন্ম হোক আমি তা চাই না’।
‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’ থেকে শুরু। এরপর গান্ডু, তাসের দেশ এবং সর্বশেষ যার হাতে জন্ম ‘গার্বেজ’-এর। কলকাতার মানুষ তার ছবি দেখতে বা দেখাতে ভয় পেলেও গেল বছর তার নির্মিত গার্বেজ-এর প্রিমিয়ার হয়েছে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে! এরপর আরো আরো উৎসবে। হ্যাঁ, সেই বিপজ্জনক মানুষটির কথাই বলছি। যে কৌশিক মুখার্জীকে হত্যা করে ‘কিউ’ নামটি ধারণ করে আছেন।
তার সৃষ্টি, সিনেমা নিয়ে ভাবনা, একার পথ চলা, ব্যক্তিগত প্রেম-এসমস্ত কিছু নিয়েই আড্ডা দিয়েছেন জুয়েইরিযাহ মউ ও মিতুল আহমেদ-এর সাথে। চ্যানেল আই অনলাইন-এর পাঠকদের জন্য চার পর্বের দীর্ঘ আলাপের দ্বিতীয় পর্ব থাকলো:
কৌশিক মুখার্জী কখন মারা গেলেন?
- কৌশিক মুখার্জী মারা গেল ২০০১ সালে। পাসপোর্টটার জন্য ওকে মেরে ফেলি। কারণ কিউ-কে পাসপোর্ট দিবে না।
কৌশিক মুখার্জী-কে মেরে কেন কিউ হলেন? কৌশিক-এর কী কী অবস্টাকল ছিল?
- কিছুই করতে পারতো না কৌশিক, কৌশিক হল মেন্দামারা একটা মধ্যবিত্ত বাঙালি। তার প্রচুর ভয়, প্রচুর পিছুটান, নানা রকম অবস্টাকল। তাকে মরতে হবে। সে না মরলে, তাকে কমপ্লিটলি এনাইলেট (ধ্বংস) না করলে কিছুই করা যাবে না। কিছুই করা যেতোও না। যা যা করা হয়েছে সেটা করতে গেলে পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকে একটা বিরাট চাপ আসে। এই যে সেদিন ঢাকা লিট ফেস্টের প্যানেল ডিসকাশনেও যে কথা হচ্ছিল যে একজন মেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কোন ফর্মূলা আছে কি না? ফর্মূলাটাই ওটা যে তোমাকে কমপ্লিটলি নিজের সত্তাটাকে কেটে ফেলতে হবে। কিউ এর কোন পরিবার নেই।
শিশুদের কাছে এই যে খিস্তি দিয়ে বিপ্লব এটাকে পৌঁছানো বা না পৌঁছানো নিয়ে কিউ কী ভাবে? একটা বয়স পর্যন্ত মানব-শিশু এই খিস্তিগুলো না জানুক এমন কিছু কি কিউ ভাবে?
- প্রধান ব্যাপার হচ্ছে, আমি যখন ঠিক করলাম ফিল্মমেকার হবো তখন এই যে সামাজিকভাবে নিজের অবস্থার পরিবর্তন এটা একটা জিনিস ছিল। আরেকটা জিনিস ছিল যে টেকনিক্যালি রেডি হতে হবে আমাকে। তার জন্য কিছু অবস্টাকলস নিজেকে দেওয়া হয়েছিল যে কোন কোন জিনিস আমার পছন্দ না। শিশু। এতে আমি আর কোন ইন্টারেস্ট দেখি না। মানে আর একটাও শিশু পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া উচিৎ না। জাস্ট স্টপ! লাইক দ্য গভর্মেন্ট। গভর্মেন্ট স্যুড স্টপ। রিপ্রোডাকশন স্যুড স্টপ। ইউ স্যুড জাস্ট স্টপ এভ্রিথিং। এভ্রিথিং ইজ সো ফাকড আপ! উই ইভেন ডোন্ট নো হোয়াট দ্য ফাকড উই আর ডুইং। অথচ কনস্টেনটলি আমরা করে যাচ্ছি। যাই হোক, এগুলো সব ইউটোপিয়া, কখনোই হবে না। কিন্তু এটাই আমার মনে হয়! এবং আমার জীবনে আমি এটাকে এপ্লাই করবো। এবার এগুলো করতে গেলে নিজের উপরে কিছু নির্যাতন করতে হয়। তার মধ্যেও একটা আনন্দ থাকা উচিৎ। সুতরাং ঠিক করলাম, শিশু যেহেতু পছন্দ না, আমি কোন রকম শিশুদের নিয়ে কাজ করবো না। কেন? কারণ হেভি ইজি। বাচ্চা পয়দা করা আর বাচ্চা দেখিয়ে ইমোশন ইউটিলাইজ করা– দু’টো সবচেয়ে ইজি কাজ। যেকোন মানুষ করতে পারে। সিনেমা সবাই বানাতে পারে না। আরেকটা হচ্ছে ভায়োলেন্স, আমি একেবারেই ভায়োলেন্স দেখাতে চাই না। বাচ্চা এবং বন্দুক ইউজ করা যাবে না, এটা আমি ভেবেই নিয়েছিলাম। দশ বছর আমি ফিল্ম বানিয়েছি এ দু’টো জিনিস ছাড়া। এবারে ভাবুন একবার যতগুলো ছবি এখন অব্ধি দেখা আছে এ দু’টো জিনিস যদি বাদ দিয়ে দেই তাহলে প্লটটা কী থাকবে? বন্দুকটা বের হল শট চেঞ্জ হয়ে গেল, বাচ্চা হল ফ্যামিলির ক্রাইসিস, ড্রামা এসে গেল! সিনেমা থেকে টেনে নেই ওগুলো? দেখবেন সিনেমা শেষ, আর কিচ্ছু থাকলো না! অধিকাংশ পপুলার সিনেমা শেষ হয়ে যাবে এগুলো ছাড়া।
গান্ডু-কে দেখে ভায়োলেট মনে হয়, কিন্তু পুরো সিনেমায় কোন ভায়োলেন্স নেই একটা চড় খাওয়া ছাড়া। কিন্তু আইডিয়াটা এতোটা ভায়োলেন্স ক্রিয়েট করে রাখে মগজে যে ভায়োলেট মনে হয়। এটা কী করে সিনেমাটিক ওয়েতে ক্রিয়েট করতে হয় আসল ভায়োলেন্স দেখানো ছাড়া দ্যাট ওয়াজ মাই ট্রিক। ঐভাবে আমি জিনিসটাকে দেখি। শিশুদের জন্য কিছুই আমি করতে রাজি নই।
গান্ডু– এই যে শব্দটা কী করে মাথায় এলো সিনেমার শিরোনাম হিসেবে?
- এটা হল কি ‘শাড়ি’ (ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস) নিয়ে ২০১০-এর দিকে অনেক বড় একটা ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার কথা ছিল, আমরা খুব প্ল্যান ট্যান করছি। একটা বড় ইন্টারন্যাশনাল কো-প্রোডাকশন হবে টবে। ২০০৯-এ ‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’ রিলিজ পায় এবং খুব সাকসেসফুল ডিস্ট্রিবিউশন হয়। তখনই আমি ভাবি নেক্সট এটা করা যায় (‘শাড়ি’)। তো হিউজ কো-প্রোডাকশনের সুযোগও পেয়ে গেলাম, ফ্রান্সে, ফেব্রুয়ারি ২০১০, পিচিং করতে যেতে হবে। তো আমার যা যা সঞ্চয় ছিল সমস্ত ওখানে লাগিয়ে দিয়ে, এভ্রিথিং ইজ সেট। শুধু আমার পাসপোর্টটা যখন ফিরে এল শনিবারে দেখা গেল স্টাম্প নেই পাসপোর্টে। স্টাম্পটা যে মেরেছে সে লাগাতে ভুলে গেছে, এমন না যে ভিসা রিজেক্ট হয়েছে, কারণ রিজেক্ট হলে তো রিজেক্টেড সিল থাকতো। সুতরাং আমার ভিসা নেই, আমার রবিবারে ফ্লাইট ছিল, মিস হল। উই লস্ট হিউজ এমাউন্ট অব মানি এবং সেখানে অংশ নিতেও পারলাম না। একদম কলাপসড হয়ে গেলাম, কিচ্ছু করার নেই, অফিস টফিস তুলে দিতে হবে। এরকম একটা অবস্থা। সেই সময় আমরা একদিন বসে ভাবছিলাম এরকম কেন হল – আমরা কি গান্ডু যে আমাদের সাথে এমন হল? না কি এই যে ভিসা প্রসেস যে বার করেছে সে গান্ডু? না কি অই মালটা গান্ডু যে স্টাম্প লাগাতে ভুলে গেল? পুরো জিনিসটা গান্ডুতে এসে আটকে গেল। মনে হল, এছাড়া উপায় নেই, ক্যামেরাও আছে, ছেড়ে যাওয়ার আগে এই মালটা নামিয়ে দিয়ে যাই!
গান্ডু- চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, অনুব্রত বসু। এর আগে এরকমভাবেতো বাংলা ছবিতে ন্যুড চরিত্র দেখা যায়নি। তো তাকে কীভাবে আপনি এইরকম চরিত্রের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন?
- ও অনেকদিন ধরে নাটক করছে, এর মানেই তার ফিজিক্যাল এক্টিং এর একটা জায়গা থাকবেই যা কেবল সিনেমা এক্টরদের থেকে আলাদা। এর সাথে আমার বিশিষ্ট বন্ধু জয়রাজ, যে রিক্সা ক্যারেক্টারটা করেছে। তার প্রচুর অবদান গান্ডু-তে। সে না হলে হতো না। আমি বললাম ওকে এরকম করবো, তুই রিক্সা হবি। কী করবো কীভাবে করবো জানিনা। পয়সাও নেই, রিক্সারও অনেক দাম, আমাদের রিক্সাও নেই। আবার কলকাতা থেকে হাওড়ায় সেই রিক্সা নেওয়াও ঝামেলা। হাওড়াতে, জয়রাজের বাড়িতে, জয়রাজের পাড়াতেই শ্যুটিং। সমস্ত পাড়ার লোক অনেক হেল্প করে। তো আমরা শ্যুটিং এর প্ল্যান করছি, কাস্টিং করছি, দেখছি টেখছি কাউকে পাচ্ছি না। তখন একদিন জয়রাজ ওকে নিয়ে ঢোকে এবং পরিষ্কার আমরা দেখতে পাই এই তো গান্ডু। এরপরে আর কিছু ভাবিনি। জয়রাজই ওদের এক মাসের একটা ওয়ার্কশপ নেয় Jwodoscy method-এ। প্রচন্ড শক্ত সেটা, সবাইকে ন্যাংটো হয়ে থাকতে হতো সারাক্ষণ। দশ দিনের মাথায় ওরা তারপর ভুলেও যায় যে কী হচ্ছে না হচ্ছে। জামা কাপড় পরলেই অশান্তি হচ্ছে তখন! সেক্সুয়ালিটিকে কেটে দেওয়া ন্যুডিটি থেকে এটাই মূল সমস্যা তো? যে আমাদের সারাক্ষণ সেক্সুয়ালিটি নিয়ে এতো সংকোচবোধ, উলঙ্গ শরীরটাকে আমরা সেক্সুয়ালিই খালি দেখি। নিজের শরীরকেই, যে অই শালা কেউ যদি দেখে ফেলে যে আমার এটা ঝুলে গেছে, আমার সেটা ঠিক নেই। আর পরের শরীর তো বটেই। ঐটা দিয়ে আমরা এতো প্যারানয়েড যে ন্যাংটো শরীরটা নিতে পারি না।