যে রাঁধে সে মহাকাশেও যায়! কথাটা বাংলাদেশের নারীদের জন্য এখনো প্রযোজ্য না হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নারীদের জন্য সত্য। তাদের হয়ে কল্পনা চাওলা মহাকাশে গেছেন। বাংলাদেশের নারীরা মহাকাশে না গেলেও কেবল আর চুল বাঁধাতেই থেমে নেই। তাঁরা এখন যে রাঁধে সে ক্রিকেট-ফুটবলও খেলেন, ভারোত্তোলন-সাঁতারেও সেরা। শুধু খেলেনই না, মাঝে মধ্যে অবিশ্বাস্য দুর্দান্ত সব সাফল্য চিত্রিত করে সবাইকে চমকে দেন। জানান দেন, আমরাও ছিলাম সকলের সময়ে, সকলের মত সক্ষমতা নিয়েই। তেমনি সব অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন আর অনুপ্রেরণাদায়ী পাঁচ নারীর গল্প জানি চলুন-
গল্পটা সালমা খাতুনের
সকালের রোদ আর সন্ধ্যের আলো তাকে ফাঁকি দিতে হতো। খুলনার মিলকী দেয়াড়া গ্রাম। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সালমা খাতুনের নানা বাড়ি। এখানেই ওই ফাঁকির কাজটা সারতেন তিনি। মামাদের সঙ্গে শাসনের চোখ লুকিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। কিন্তু ঘরে ফিরলে নিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারতেন না। তবু সালমা লুকোচুরি করতে করতে ক্রিকেট খেলে যেতেন। থ্রি-পিস পরা একটি মেয়ে ক্রিকেট খেলছে, ব্যাপারটা লোকে নিতেই পারতো না। অবজ্ঞার অট্ট হাসি মাঠের চারপাশে বিষাক্ত বাতাসের মতো ঘুরে ফিরতো। সালমা সেই পরিস্থিতি জয় করেছেন ব্যাট আর বল দিয়ে। সামলিয়েছেন জাতীয় অধিনায়কের দায়িত্বও।
‘কখনোই মন খারাপ করতাম না। কটু কথায় কান দিতাম না। নারকেল গাছের ডাগরো দিয়ে টেনিস বলে খেলে শুরু। মামারা উতসাহ দিতেন।’ সালমা খাতুন শৈশবের স্মৃতি আওড়ান আর কণ্ঠ ধরে আসে, ‘পেছনের সেই দিনগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। গ্রামে যারা কটু কথা বলতেন তারাই এখন বেশি খুশি হন। উৎসাহ যোগান আরও ভালো করতে। আগে যারা চাইতেন না আমি খেলাধুলা করি সেসব বাবা-মা তাদের সন্তানদের ক্রিকেটে দেওয়ার জন্য এখন আমার খোঁজ করে।’
বাবার চিকিৎসার জন্য সোনার পদক বিক্রি
ঘরে অসুস্থ বাবা। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ডাক্তারের কাছে যেতে হলে টাকা লাগবে। সম্বল বলতে অনেক সাধনার এক সোনার পদক। মাবীয়া আক্তার সীমান্ত বুকে পাথর বেঁধে সেই পদক বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করালেন। জীবনের চোরাগলিতে এমন যুদ্ধ তিনি অনেক জিতেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএস গেমস) কোর্টে আগের রাতে কনুই ভাঁজ করতে পারছিলেন না। গরম সেঁক দিয়ে ঘুমাতে যান। পরের দিন তার অদম্য ইচ্ছেশক্তি সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে! সেদিন ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে বাংলাদেশের জন্যে আসরের প্রথম সোনার পদক এনে দেন মাবিয়া। পদক নিতে মঞ্চে উঠে আর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সোনা জয়ের আনন্দে কাঁদতে থাকেন বাংলাদেশের ‘সোনার মেয়ে’। তার ওই আনন্দ অশ্রু হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা হযে গঙ্গা থেকে যমুনায় ঢেউ তুলেছিল।
দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মাবিয়া সবার ছোট। সংসারে নিত্য অভাব-অনটন লেগেই থাকত। সংগ্রাম করেই মাবিয়ার এগিয়ে চলা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় টাকার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে বক্সার মামা কাজী শাহাদাৎ হোসেন ২০১০ সালে নিয়ে আসেন খেলার জগতে। পাড়ার মাঠের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাত্রা। পরে ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। চাকরি পেয়েছেন বাংলাদেশ আনসারে। চাকরি করছেন বাহিনীটির ব্যাটালিয়ন পদে। স্বপ্ন দেখেন একদিন অলিম্পিকে খেলবেন।
সাংবাদিকতার মেয়েটি বৈষম্যের জবাব দিয়েছেন সাঁতারপুলে
সারুসাজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জাকির হুসেন সুইমিংপুলের টাচ প্যাডটা স্পর্শ করার পর মাইকে ঘোষণা এলো- ‘এবারের গেমসে রেকর্ড গড়ে সাঁতারে সোনা জিতলেন বাংলাদেশের মাহফুজা খাতুন শিলা।’ গৌহাটির সাউথ এশিয়ান গেমসের ঘটনা এটি। যেটি স্বপ্নময়ী মেয়েটিকে পৌঁছে দিলো আরো অনন্য এক উচ্চতায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার মত বিষয়ে পড়া মেয়েটি স্বপ্নের পিছে ছুটে সাহসিকতার আরেক নাম হয়ে উঠলেন সাঁতারপুলে।
এসএ গেমসে সাঁতারে মেয়েদের ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে রেকর্ড গড়েছেন মাহফুজা। সময় নেন ৩৪.৮৮ সেকেন্ড। এই ইভেন্টের ফাইনালে সাঁতরানোর আগে হিটে সময় নিয়েছিলেন আরো কম, মাত্র— ৩৪.৬৬ সেকেন্ড! যেটি ভেঙেছে দক্ষিণ এশিয়ার ১০ বছরের পুরোনো রেকর্ড। সেই রেকর্ডের একদিন আগেই ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকেও সোনা জিতেছেন। যেটি বাংলাদেশের সাঁতারে ইতিহাসে গেমসে সোনাজয়ী প্রথম লাল-সবুজের নারী সাঁতারুর স্বীকৃতি দেয় শিলাকে। সর্বশেষ জাতীয় সাঁতারেও এসএ গেমসের রেকর্ড টাইমিংও টপকেছিলেন।
অথচ বঞ্চনায় এগিয়েছে শিলার জীবন। শৈশব থেকেই সাঁতারে ঝোঁক ছিল। স্বপ্নকে সাফল্যে পথে টেনে নেওয়ার পথে চারপাশের মানুষগুলোর কাছে তাচ্ছিল্য জুটেছে। মেয়ে সংসারী হবে, সে কিনা আঁট-সাঁট কাপড় পরে পানিতে মাতম তুলবে; এটা মেনে নিতে পারছিলেন না কাছে-দূরের অনেকেই। তাই সংগ্রাম ছিল স্বপ্নকে বাড়তে দেওয়ার। চারপাশের উপেক্ষাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়ার। শিলা সেটা পেরেছেন। দমে যাননি। যশোরের নওয়াপাড়ার মেয়েটি সকল বৈষম্য আর উপেক্ষার জবাব দিয়েছেন কেবল সাঁতারপুলেই। হয়ে উঠেছেন অগনিত শিলার স্বপ্নের সঞ্চারক। অসংখ্য গর্ব করার মতো অর্জন তার স্মৃতিতে।
শুধু খেলার জন্য বাবার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা
মেয়েটি অপেক্ষা করত বাবা কখন ঘুমিয়ে যাবে, তখন একটু খেলতে যাওয়ার সুযোগ মিলবে। সেটা না হলে ঝুঁকি নিয়ে জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে। একদিন সেই বাবাই চমকে দিয়ে বললেন, আমি ছোট থাকলে এখন খেলেই শুরু করতাম। অজো গ্রাম থেকে বিকেএসপিতে এসে দেশের দ্রুততম মানবী হওয়ার শুরুটা এভাবেই হয়েছিল শিরিন আক্তারের।
শুধু বাবাই নন, পরিবার-স্বজনদের কেউই চাইতেন না শিরিন খেলধুলায় জড়াক। তাই অপেক্ষা ছিল বাবার ঘুমিয়ে পড়ার। বাবাও কম যান না, আদরের মেয়েটিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। আর মেয়েটির জেগে জেগে অপেক্ষা। সেভাবে সুযোগ না হলে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়া, আর ছাদ থেকে বড় বোন ছুঁড়ে দিতেন একটা টি-শার্ট বা ট্রাউজার। স্কুলে যেয়ে তবু যে নিস্তার মিলত তা নয়। সেখানে খেলার জন্য কেবল ছেলেদেরই পাওয়া যেত। তবু দমে যাননি। বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ দিয়ে উঠে আসা। পরে কোচ আব্দুলাহ হেল কাফির কাছে দীক্ষা।
বাবা শেষ পর্যন্ত বিকেএসপিতে আসতে দিয়েছেন। তখন বয়স ১৪ বছর। ২০০৭ সাল। ৪০০ মিটারে দ্রুততম জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়ে হৈ-চৈ ফেলে দিলেন। এরপর কেবল এগিয়ে যাওয়া। জাতীয়তে দ্রুততম কিশোরী-বালিকা-মানবী হওয়ার একমাত্র বাংলাদেশি খেতাবটা শিরিনের দখলে। দ্রুততম মানবী হয়েছেন চারবার। শিরিন নারী দিবসে তার উঠে আসার, এগিয়ে যাওয়ার কথাগুলো বললেন। আর আগামীর শিরিনদের জন্য দিলেন বার্তা- লেগে থাকতে হয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবল খেলতে যাওয়া প্রথম বাংলাদেশি
শহরের মানুষ যখন ঘুমকাতুরে, সেই কাকডাকা ভোরেই ইতিহাসের একটি দরজা উন্মুক্ত করলেন সাবিনা খাতুন। উড়াল দেন মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে। মালদ্বীপ তিনি যেতেই পারেন। তবে এ যাওয়ার যে অনেক মহিমা। বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে খেলতে যাচ্ছেন ভিনদেশের কোন ক্লাবে। সেখানে ‘ক্লাব মালদ্বীপস্ উইমেন্স ফুটসাল ফিয়েস্তা’ নামের একটি টুর্নামেন্টে মালদ্বীপ পুলিশ ক্লাবের হয়ে খেলবেন তিনি। পরে টুর্নামেন্টের ৪ ম্যাচে ৩৩ গোল করে হৈ-চৈ ফেলে দেন।
সাতক্ষীরা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে কেবল মোস্তাফিজ-সৌম্যকেই দেয়নি, দিয়েছে সাবিনা খাতুনের মত তুখোড় এই ফুটবলারকে। মুসলিম পরিবারে জন্ম। ঘরের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ির মাত্রাটা প্রবল। সেই তিনিই কিনা এখন বাংলাদেশের মেয়েদের ঘরোয়া ফুটবলে সেঞ্চুরি গোলের মালিক। ‘গোলমেশিন’ হিসেবে খ্যত। লোকে হাসত। পরিবারের কাছে কটু কথা বলত। এগিয়ে তো দিতই না, পিছু টেনে ধরতে চাইত প্রতিমুহূর্তে। লাল-সবুজদের জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হওয়ার পর অবশ্য এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। সাবিনা খাতুন ২০০৮ সালে সাতক্ষীরার হয়ে জাতীয় নারী ফুটবলে অংশ নিয়ে প্রতিভার প্রথম ঝলকটি দেখান। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।