করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলা এবং সরকারি খাদ্য সহায়তা- এ দুই বিষয় এই মুহূর্তের টক অব দ্য কান্ট্রি। করোনা মোকাবেলায় সরকারের নানা পদক্ষেপ আর সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া মানুষদের ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সারাদেশ বিশেষ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উত্তাল।
এই সময়ে প্রথম বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-হতাশা-আশাবাদ যেমন আছে তেমনি আছে ত্রাণ লুটপাট নিয়ে খবর। গণমাধ্যমে তথ্য অনুযায়ী সরকারি এই ত্রাণ সহায়তার যেখানে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বণ্টন আছে সেখানে চুরির মচ্ছব জমেছে। এই ত্রাণ চুরি কার্যক্রম এককভাবে পরিচালনা করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রান্তিক পর্যায়ের নেতারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসহায়দের সহায়তা নিয়ে যেকোনো ধরনের অনিয়ম কঠোরভাবে দমনের যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সেটা কাজে দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিকে তোয়াক্কা না করে দেশের নানা জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজন যেভাবে লুটপাট চালাচ্ছে তাতে করে সরকারের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও সরকারপ্রধানের আদেশ মান্য করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। প্রশাসন এবং পুলিশ-র্যাবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় নানা অভিযান পরিচালনা হচ্ছে ঠিক কিন্তু তারপরেও থেমে নেই এই অনিয়ম।
কেবল অভিযান পরিচালনা করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না সরকার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একাধিক ত্রাণ চোরকে বহিস্কার করেছেও। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন নাই, কিন্তু দিনশেষে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাবে ওই লুটপাট সামনে আসছে। কারণ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন এই ত্রাণ চোরেরা বেপরোয়া, প্রশাসনের নানা পদক্ষেপকে পাত্তাই দিচ্ছে না বলেই মনে হয়।
গত কয়েকদিন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কজন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ডিলার ত্রাণ চুরিতে ধরা পড়েছেন। এই তালিকায় ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও আছেন। এদের মধ্যে কেবল জনপ্রতিনিধিই কেবল নয় ১০ টাকা দরের চাল বিক্রির ডিলারও আছেন। এই ডিলারদের প্রায় শতভাগ আওয়ামী লীগের নেতা। অনেক জায়গায় দেখা যায় কেবল দলীয় রাজনীতি করার কারণে তারা সরকারি চাল বিক্রির ডিলারশিপ পেয়েছেন। স্রেফ একটা ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ব্যবসায়ী হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের খাতায় নাম লিখিয়ে এই চাল বিক্রির অনুমোদন নিয়েছেন।
এখানে যতটা না তাদের কমিশনভিত্তিক ব্যবসা তারচেয়ে বেশি চালে নয়ছয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। এই ডিলারশিপ প্রদানের আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে এমন ঘটনা ঘটেছে। এটা ঠিক দেশের এই ক্রান্তিকালে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করে নতুন করে ডিলার নিয়োগের সুযোগ সীমিত কিন্তু আগেকার সেইসব ভুলের মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে দেশকে।
গণমাধ্যমে ত্রাণ চুরির যেসকল সংবাদ বেরিয়েছে সেসব পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বশেষ তথ্য নয়। এরবাইরে আরও আছে নিশ্চিতভাবে, যাদের অনেকেই ধরা পড়ছে না; বা স্থানীয় প্রভাবের কারণে অনেক সংবাদই প্রকাশ হচ্ছে না; অনেক সংবাদ প্রকাশ হলেও আলোচনায় আসছে না। অনেক জায়গায় তালিকা ঠিক রেখে সরকারি সহায়তা কম দেওয়ার অভিযোগ আছে।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের আউশকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুনের অনিয়মের খবর স্থানীয় এক সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ করতে গেলে ওই চেয়ারম্যান তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সাংবাদিকের ওপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ আছে। ওই চেয়ারম্যান এক সাংবাদিককে ক্রিকেট ব্যাট দিয়েও পিটিয়েছেন। এই সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে, কিন্তু ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগে মামলা হলেও ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ, অসহায়, হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ ও শিশু খাদ্য সহায়তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২৮ কোটি ৪৫ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ৬৫ হাজার ৯৬৭ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের যেকোনো দুর্যোগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এইধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। করোনার সময়ে যখনই দেশে প্রথম দফা ছুটি ঘোষণা করা হয় তখনই এই ধরনের সহায়তা কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। এটা তার সরকারের জন্যে নূতন কিছু নয়।
এরআগেও বন্যার সময়ে যখনই মানুষজন আক্রান্ত হয়েছে তখনও এইধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এরবাইরে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে খাদ্যবান্ধব এমন নানা সামাজিক কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এগুলো তার সরকারের মানবিক কর্মসূচি। এইধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন যেখানে প্রান্তিক পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে হওয়ার কথা ছিল সেখানে তার নিজেদের দলের লোকজনই প্রধানমন্ত্রীর এইসব উদ্যোগকে ব্যর্থ করতে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর মানবিক কর্মসূচি ব্যর্থ করে দিতে অভিনব এক পন্থা অবলম্বন করেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবসার। ত্রাণ দিতে লোকজনকে জড়ো করে ছবি তুলে মানুষদের কাছ থেকে সেগুলো কেড়ে নিয়েছেন। এই সংবাদ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে এবং তদন্তের আলোকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাকে কেন স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে না এই মর্মেও কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়েছে। এই ইউপি চেয়ারম্যান আবার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। তার বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরির অভিযোগ নতুন নয়।
এ মাসেই অনিয়মের অভিযোগ এনে ইউনিয়নের সাতজন সদস্য তার ওপর অনাস্থা এনে লিখিত অভিযোগ ইউএনও বরাবর দিয়েছিলেন। ইউএনও অনাস্থা প্রস্তাবের সেই চিঠি জেলা প্রশাসকের কাছেও পাঠিয়েছিলেন। নুরুল আবসার চেয়ারম্যান হয়েই এই দুর্বৃত্তপনা চালিয়েছেন এমন না। তার নির্বাচনী প্রক্রিয়াও ছিল চরম বিতর্কিত ও অসাধু পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে। ২০১৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাল ভোটের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার এই জাল ভোট প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের নুরুল আজিম রনি। বিতর্কিত সাবেক এই ছাত্রনেতা নুরুল আবসারের পক্ষে ভোট কারচুপি, ব্যালট পেপারে ব্যবহৃত একটি সিলসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েন।
ওই ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ভোটকেন্দ্রে অবৈধভাবে প্রবেশ ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে ইউপি নির্বাচন আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন রনিকে, এবং এরপর হাটহাজারি থানায় অস্ত্র আইনে মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে। ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের সময় নুরুল আজিম রনির কোমরে পিস্তল ও সাতটি গুলি গোঁজা ছিল এমন তথ্য উল্লেখ করে অস্ত্র আইনের মামলার অভিযোগপত্র ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে।
চেয়ারম্যান নুরুল আবসারের ভোট চুরি, আত্মীয়স্বজন ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ভয়ভীতি আর অস্ত্র প্রদর্শন করে নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার এই উদাহরণ টেনে আনার কারণ দেশের নানা জায়গায় যারাই ত্রাণ চুরির মত অপকর্ম করেছে তাদের অনেকেই একই ধারায় নির্বাচিত হয়ে আসা। তারা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করে চেয়ারম্যান কিংবা ইউপি সদস্য হয়েছে; এই হিসাবে তাদের কাছ থেকে জনসেবা এবং নৈতিকতার আশা করাটাই বাহুল্য।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আওয়ামী লীগকেই বিতর্কিত করছে তারা। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, হুঁশিয়ারি এবং মানবিক আকাঙ্ক্ষার মূল্য নাই তাদের কাছে। এই না থাকার কারণ মূলত অনৈতিক পথ অবলম্বন যা তাদের নির্বাচনে জয়ের প্রক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে দুর্যোগ কবলিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের মানবিক কর্মসূচিগুলো যখন বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল তাদের দলেরই কিছু সংখ্যক চেয়ারম্যান ও সদস্য ও নেতাদের দ্বারা সেটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই না হওয়ার মূলেও আছে আওয়ামী লীগ, কারণ দলটিই ইউনিয়ন নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে প্রান্তিক পর্যায়ে এমন অনৈতিকতাকে আশকারা দিয়েছিল। দলটির এই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে দেশকে, নিরন্ন মানুষকে, একই সঙ্গে সরকারকে।
এটা ঠিক দেশের সকল অঞ্চলে একইভাবে সবাই লুটপাটে জড়িত এমন না, তবে কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা বদনামের ভাগিদার হচ্ছে পুরো দল ও সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে তার আন্তরিকতার প্রমাণ রাখছেন। এই আন্তরিকতার সফল বাস্তবায়নে দরকার সকল পর্যায়ের সকলের একাত্মতা পোষণ।
ত্রাণ চুরি করছে আওয়ামী লীগ, ত্রাণ চোরদের ধরছে আওয়ামী লীগই- এটাকে কোনোভাবেই সরকারের রক্ষাকবচ ভাবা উচিত নয়। দুর্বৃত্তদের চেয়ারম্যান, মেম্বার আর ডিলার বানিয়ে এরপর তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করার ফল ভালো হয়না।
দুর্বৃত্ত মানসিকতার লোকদের দুর্বৃত্তপনা চালানোর মত অবস্থান আর শক্তি দেওয়াটাই ভুল হয়েছে দলের। এই ভুলের মাশুল যেন দেশ আর বেশি না দেয় সেজন্যে আরও কঠোর হোন। প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি কার্যকর করতে শুরু করুন। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি দল থেকেও তাদের বহিস্কার করুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)