শোকের মাস আগষ্টের শুরুতেই এক সচেতন বন্ধু তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন, “আগষ্ট মাস এলে মুজিব কোটের চাহিদা বেড়ে যায় জানি, আগষ্ট এলে মুজিব সম্পর্কিত বইয়ের চাহিদা বাড়ে কি?”। প্রশ্নটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইংগিতপূর্ণ এবং সচেতন মহলের ভাবনারও বিষয়। মুজিবের কাজ নিয়ে গবেষণা বা তাঁকে নিয়ে ভাল একখানা বই! সে তো এক দূরাগত স্বপ্ন! মুজিব কোটের নব-সংস্করণেরইতো আজকাল জয়জয়কার! এখনকার নব্য রাজনীতিকেরা দর্জির দোকানে মুজিব কোটের অর্ডার দেবার সময়ে ফিসফিসিয়ে বলে দেন যেন কোটের পকেটগুলো বড়সড় করে তৈরি করা হয়। পকেট বড় না হলে মুজিবকে বিক্রি করে ওদের যত রোজগার, তা ওরা রাখবে কোথায়?
মুজিবভক্ত লেখকেরা পাঠকদের জন্য মুজিব-দর্শন উপস্থাপনের তাগিদ অনুভব করেন না। আবার (মুজিব ভক্ত) পাঠকদেরও ‘মুজিবকে জানার’ তেমন আগ্রহ নেই। সবাই যেন মুজিব বন্দনা করছেন ‘প্রাপ্তিযোগের’ জন্য এবং নিজ ক্ষমতাটুকু সংহত রাখার জন্য। অথবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাকে তুষ্ট রাখার জন্য। হে পিতা, তোমার মৃত্যু মাসে তোমায় বিনত শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। আর রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে স্বগোতোক্তি করি, “তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল”।
পিতা, তোমাকে নিয়ে কোলাহল আর কিচিরমিচিরের অন্ত নেই। তোমার নিজ হাতে গড়া দলটি, তোমারই কন্যার নেতৃত্বে বেশ কিছু বছর যাবৎ রাজ ক্ষমতায়। দেশের সুবিধাবাদি রাজনীতিক-ব্যাবসায়ী, টাউট-বাটপার, গুন্ডা-বদমাস, বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানোগুলো প্রায় সবাই এখন তোমার দলে আশ্রয় নিয়েছে। তুমিতো বুঝতেই পারছো, দল বা দেশের কল্যাণ চিন্তায় নয়, নিজেদের অপকর্মগুলো নিরাপদে চালিয়ে যাওয়ার জন্যই এদের এই যোগদান।
তোমার দলে এখন বলতে গেলে এই সুবিধাভোগী শ্রেণিই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুষ্টিমেয় হাতে গোনা দুচারজন, যাঁরা ‘তোমার চলা পথে’ হাঁটতে চায়, তাঁরা বড় বেকায়দায় আছেন। তোমার সোনার বাংলায় এখন আগের যে কোন সময়ের তুলনায় ঘুষ, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি বেশি বই কম নয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ এমনটাই বিশ্বাস করে যে, তোমার কন্যা এগুলো দমনে যথেষ্ট আন্তরিক নন। এতে করে দুর্নীতিবাজেরা পরোক্ষ মদদ পাচ্ছে, তাদের পালে হাওয়া লেগেছে। পিতা, তুমি মরে বেঁচেছো, নইলে তোমার দলের নেতাকর্মীদের বৃহদাংশের নৈতিক স্খলন তুমি সইতে পারতে না।
স্মরণ করি ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। তুমি তখনই অসীমস্পর্শী নেতা, আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্ব তোমার। গণমানুষের চোখের মণি তুমি, তাঁদের আশার আলোক বর্তিকা। তোমার প্রতিটি নির্দেশনাই তখন ‘গগনে গগনে ধায় হাকি’। সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালী তোমার উপরে আস্থা রেখেছিলো, বিশ্বাস করেছিলো তোমায়। তোমার তর্জনী যে দিকে বাঁকা করতে, সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালী সেদিকেই ঘুরে দাঁড়াতো। মানুষকে তুমি ভালবেসেছিলে, অকাতরে তুমি তা ফেরৎও পেয়েছিলে।
তুমিতো শাসক নও! তুমি একই সাথে পিতা ও নেতা। কাউকে দন্ডদান তোমার কর্ম নয়। শাসনকার্যের জন্য যে কঠোর মনোবৃত্তি প্রয়োজন, সে তোমার কবেই বা ছিলো? তুমিতো দয়ার সমুদ্র! রাজাকার-আলবদররাও তোমার ক্ষমা-বঞ্চিত নয়। তোমার ব্যাক্তিত্বের সেই কোমলতার সুযোগে ৭২ থেকে ৭৫ সময়কালে তোমার নিজ দলের সুবিধাভোগীরা এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা একাট্টা হয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলো। লাইসেন্স-পারমিটের কালোবাজারি, রিলিফের মালামাল লোপাট ইত্যাদি ঘটনায় দেশটি তখন ছেয়ে গিয়েছিলো। সে পরিস্থিতিতো তোমার অজানাও নয়। আজও ঠিক একইভাবে তোমার কন্যার শাসনামল সেই শ্রেণির অপগন্ডদের খপ্পরে পড়েছে।
পিতা, জনতা সেদিন দেশ গড়ার দায়িত্ব তোমার কাঁধেই দিয়েছিলো। তুমি সেদিনের সব অন্যায়-দুর্নীতি সর্বাংশে দমন করতে পারোনি, তা সত্য। তবে তোমার আন্তরিকতা কখনও গণমানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। কারণ আইন-কানুনের আদালতে দুর্বৃত্তদের তুমি শায়েস্তা করতে না পারলেও, জনতার কাছে তোমার অপারগতা নিয়ে কৈফিয়ৎ দিয়েছিলে। প্রকাশ্য জনসভায় সেদিন দেশবাসির কাছে সেই অনাচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলে। কি অকপট সাহসী সেই স্বীকারোক্তি! স্মরণ করি তোমার নালিশের সেই পঙক্তিগুলো, “সবাই পায় সোনার খনি, আমি পাইছি চোরের খনি” বা “দেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আট কোটি কম্বল আনলাম, আমার ভাগেরটা কই গেল?”, অথবা “চাটার দলে সব খাইয়া ফেললো” ইত্যাদি।
পিতা, তোমার কন্যা জনতাকে ভয় পায়। তাইতো তার শাসনামলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা, ব্যাংক ও শেয়ার বাজারের লুন্ঠনকারীরা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক-ব্যাবসায়ী-আমলারা, দলীয় পান্ডারা, সবাই বহাল তবিয়তে। কারো বিরুদ্ধেই কার্যকর ও দৃষ্টান্তমূলক তেমন কোন আইনগত ব্যবস্থা তিনি নিতে পারছেন না। আবার তোমার মত করে জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতেও পারছেন না যে, “আমিও চোরের খনি পাইছি।” বর্তমানে তোমার দলে সৎ নেতা বা কর্মীতো প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয়। মাঝেমাঝেতো এমন সন্দেহও জাগে যে, তোমার কন্যাই বা কতটা তোমার সততা ও চেতনা ধারণ করেন? তাইতো সেই গানের চরণটি আজ বারে বারে মনে আসছে, “তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল”।
কি জান, তোমার অন্ধ ভক্তদের অবস্থা খুবই নাজুক! জন্মক্ষণে তুমি যে আদিম পোষাকে মায়ের কোলে এসেছিলে, ওরা তাও মানতে নারাজ। এই গাধাগুলো বলতে চায় যে, তখনও তোমার গায়ে মুজিব কোট ছিলো। অন্ধভক্ত আর মৌলবাদীর মধ্যে বিশেষ তফাৎ কই? অপগন্ড মূর্খগুলো বড় করতে যেয়ে তোমাকে দলীয় সম্পত্তিতে পরিনত করেছে। তুমি এখন আর বাঙ্গালীর নও, শুধুমাত্র আওয়ামীলীগারদের সম্পদ। তাইতো সঙ্গত কারণেই আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তোমাকে নিত্য ল্যাংটা করে ছাড়ে। আর আওয়ামীদেরই বা কি দোষ দেবো বল, দলেতো এখন আর রাজনৈতিক সততা বা আদর্শ বলে কিছু আর অবশিষ্ট নাই। তুমিই তাদের একমাত্র আদর্শিক আশ্রয়, তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা তাদের।
পিতা, কথা যখন উঠলোই তখন তোমাকে একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলি,-। গত আগষ্টে তোমার মৃত্যুদিনে বাংলাদেশের একটি জেলা শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভার দৃশ্য সেটি। বিশাল হল ঘরে মঞ্চের পেছনে তিনটি ছবি সম্বলিত ঢাউস সাইজের ব্যানার টাঙ্গানো হয়েছে। ব্যানারে তোমার নাতির ছবিটি (জয়), সব থেকে বড় করে আঁকা। তারপরে তোমার কন্যারটি। তোমার ছবিটি ব্যানারে সব থেকে ছোট করে ছাপানো, মোটেই দৃষ্টিনন্দিত বা যুক্তিগ্রাহ্য উপস্থাপন নয়। তোমার নাতির ছবিটি ব্যানারে কেন? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার জানা মতে তিনি তো দলের স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় কোন পর্যায়েরই কোন নেতা নন!
তোমার স্মরণে আলোচনা সভা, -এমনতর প্রচার শুনেই সভা দেখতে গিয়েছি। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে দেশের রাজনীতির হাল হকিকত নিয়ে অনেক কৌতুহল আমার। দেখলাম হল ভর্তি দলীয় লোকজন, সাধারণ দর্শকদের উপস্থিতি নেই। নিজেকে খুব একা ও বিচ্ছিন্ন লাগছিল, কারণ একমাত্র আমিই সরাসরি দল করিনা; তবে দলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন একজন বটে। ব্যানারে বড় করে আলোচনার বিষয় লেখা, “মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শীর্ষক আলোচনা সভা”। নেতা, পাতি নেতায় মঞ্চ ভর্তি। মনে হচ্ছিল পুরো হলের সবাই মঞ্চে উঠতে চায়। গাদাগাদি ঠেলাঠেলি, সে এক দুর্বিসহ অবস্থা। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই দর্শক সারিতে বসে বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
জনাত্রিশেক বক্তা প্রায় ঘন্টাতিনেক বক্তব্য রাখলেন। এর মধ্যে একজন বক্তাও সভার আলোচ্য বিষয়ে অর্থাৎ “মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শীর্ষক আলোচনা” -নিয়ে একটি কথাও বললেন না। বুঝতে পারছিলাম না, এ ধরণের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা সভায় এত বক্তা কেন? বক্তাদের মঞ্চে উঠানামা, বক্তব্যের সময়ে অঙ্গভঙ্গি, ভাষার ব্যবহার, ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছিলো না যে, সভায় যে পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ে বক্তব্য রাখতে হবে; সে বিষয়টি তারা কেউ বুঝতে পেরেছেন।
বক্তাদের বক্তব্যে উঠে এলো জয় মামা ও শেখ হাসিনার কীর্তন, সভায় উপস্থিত একজন মন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি’র বন্দনা, ইত্যাদি। ‘তোমাকে নিয়ে’ আলোচনা সভায় কেউই তোমার কথা কিছুই বলছে না পিতা! আর কি আশ্চর্য জানো, তা নিয়ে আয়োজক থেকে দর্শক, কারোরই কোন মাথাব্যথা নেই। তো পিতা, এতশত শুনে তোমার হয়তো বক্তাদের বক্তব্যের ধরণ জানতে ইচ্ছা করছে। একজন বক্তার বক্তব্যের নমুনা তাহলে বলি, বাকিদেরটা তুমি আন্দাজ করে নিও। এ বক্তা জেলা পর্যায়ের একেবারে সামনের সারির নেতা, সম্ভবত: ঘুমুবার সময়েও মুজিব কোট গায়ে থাকে।
তো বক্তার জন্য নির্ধারিত সময় ছিলো ৫ মিনিট। তিনি শুরু করলেন এভাবে,-“আজকের সভার সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভাপতি (অমুক ভাই), সভায় উপস্থিত মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুর, আমাদের নয়নের মনি, দুর্দিনের কান্ডারী স্থানীয় সংসদ সদস্য, বিল্পবী জননেতা (অমুক ভাই), উপস্থিত নেতা-কর্মীবৃন্দ, আসসালামুওয়ালাইকুম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আদর্শ ধন্য হতে পেরেছি বলে আমি গর্বিত। আজকের এই সভা থেকে আমি সংগ্রামী অভিবাদন জানাই যুব নেতা, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কান্ডারী, আগামী দিনের বঙ্গবন্ধু, জয় ভাইকে (দলীয় ভক্তদের মুহুর্মুহু করতালি)।
বন্ধুরা জয় ভাই যদি আজকের সভায় উপস্থিত থাকতেন তাহলে তিনি দেখতে পেতেন যে, বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা আজ তাঁর পতাকা তলে সমবেত। আমার বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে আমি জয় ভাইয়ের নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত।” -এ পর্যায়ে এই বক্তার কথা বলার নির্ধারিত সময় শেষ, তাকে মঞ্চ ছাড়তে হলো। সেদিন কিন্তু কোন বক্তাই তোমার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ নাই। সভায় উপস্থিত মন্ত্রী বা এমপি বাহাদুরও সে অপকর্মটি করতে ভুল করেননি। আসলে ওরা তোমাকে জানেও না, বোঝেও না। পিতা, সেজন্যেই তো আমার এই রচনাটির শিরোনাম দিয়েছি, “তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না,..”।
‘মুজিব দর্শন’, ‘মুজিব দর্শন’ বলে গলা ফাটাচ্ছি আমরা। পিতা, আসলে তোমার দর্শনটি কি? কাল মার্কেসর মত রাজনীতি নিয়ে তুমিতো দর্শনের বই রচনা করে যাওনি। তুমিতো রাজনীতির তাত্ত্বিক নও, কর্মদানব তুমি। দেশকে ভালোবেসেছো, দেশের মানুষকে ভালোবেসেছো। সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করতে যেয়ে জেলে পঁচে মরেছো। দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়েছো। সর্বশেষে সেই মানুষদের জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়তে যেয়ে সপরিবারে জীবনও দিয়েছো! দিতে তো কিছু বাকি রাখোনি!
তোমার ‘দর্শন’ খুঁজতে গিয়ে, তুমি যে দেশ এবং দেশের মানুষদের ভালোবেসেছো; এর থেকে বড় কোন দর্শন তো খুঁজে পাই না। আর তার থেকে বড় ‘দর্শন’ যে কি হতে পারে, তাওতো বুঝি না! তোমার সেই দেশপ্রেম-দর্শনের চর্চ্চা যদি আজ দেশে থাকতো, তাহলে তো সোনার বাংলা সোনায় সোনায় ভরে থাকার কথা। পিতা, সাধে কি আর গানটি গাই,- “তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল। সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)