পাঁচ বছর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম ‘ঐতিহাসিক’ নির্বাচন কাভার করেছিলাম। তখন দেখেছি একটি স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে জাতীয় রাজনীতি কতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। কী রকম নাটকীয়তা চলতে পারে।
ভোটের আগের রাতে খাওয়া শেষ না করেই টেবিল থেকে উঠে দৌড় দিয়েছিলাম বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের বাসায়। কারণ ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে, কেন্দ্রের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। পাঁচ বছর আগের সেই কষ্ট আজও ভোলেননি তিনি। গত ১৯ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে অনেকটা খেদমাখা দুঃখ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আজও জানলাম না, কেন আমাকে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।’ প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় তার এখন আর আস্থা নেই বলেও জানান।
তবে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি মূলত দু’জন ব্যক্তির কারণে আলোচিত। একজন বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং অন্যজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। অনেকে যাকে ‘গডফাদার’ বলে থাকেন। যদিও এই গডফাদারকে হারিয়েই ডাক্তার আইভী গত নির্বাচনে জয়লাভ করে নারায়ণগঞ্জের প্রথম মেয়র হবার গৌরব অর্জন করেন। ভোটের দিন বিকেলে যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলো যে আইভীই জয়ী হতে চলেছেন, তখন সাংবাদিকদের সামনে শামীম ওসমান আবৃত্তি করেছিলেন কাজী নজরুলের কবিতা- ‘বন্ধু বড় বিষজ্বালা এই বুকে।’
কিন্তু যে নাটকীয়তা আর উত্তেজনা ছিল ২০১১ সালে, তাতে মোটেও ভাটা পড়েনি এই পাঁচ বছরে। বরং আকারে প্রকারে তা আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে বলে মনে হয়।
নির্বাচনে দল কাকে মনোনয়ন দেবে, সেটি তৃণমূলের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে বলে রাজনীতিবিদদের তরফে দাবি করা হলেও, নারায়ণগঞ্জে দেখা গেল ঠিক এর উল্টো। কারণ গত ১৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগ সিটি নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যে তিনজনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠায়, সেখানে আইভীর নাম ছিল না। এ বিষয়ে পরদিন তিনি সাংবাদিকদের জানান,আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলে প্রার্থী হবেন না। বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করবেন না। দল যে সিদ্ধান্ত দেবে, তাই মেনে নেবেন।
দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউজে মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় উপস্থিত কোনো নেতাই আইভীর নাম প্রস্তাব করেননি। সভায় মহানগর সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা সভাপতি আবদুর রশিদ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সভাপতি মজিবর রহমানের নাম সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, সভায় আইভীর নাম প্রস্তাব করা হবে। কেউ তার নাম প্রস্তাবই করেনি।’ আইভীকে উদ্দেশ্য করে শামীম ওসমান বলেন, ‘ছোট বোন, এত দাম্ভিকতা ও অহঙ্কার ভালো নয়।’
তবে গণেশ উল্টে যায় ১৮ নভেম্বর। ওইদিন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখন প্রশ্ন হলো, যদি আইভীকে সত্যি সত্যিই তৃণমূল মনোনয়ন না দিয়ে থাকে, তাহলে কেন্দ্র কেন তৃণমূলের সেই মতামত অগ্রাহ্য করল? নাকি তৃণমূলের মতামত বলে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা আসলে শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত মতামত? নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি সম্পর্কে যারা মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন, তারা বুঝতে পারছেন, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই জোরালো। অর্থাৎ তৃণমূল থেকে আইভীর নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে না পাঠানোর এই ঘটনা যে আইভীর প্রতি মি. ওসমানের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
২.
আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা চরিত্র, সেখানে তৃণমূলের মতামতের আসলেই মূল্য কতটুকু? কারণ তৃণমূলের মতামত কতটা মূল্যবান তা নির্ভর করে তৃণমূলে গণতন্ত্রের চর্চা কতটুকু আছে তার ওপর। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় পরিষদেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই, যেখানে ব্যাপক আয়োজনে দলের কাউন্সিল করা হলেও শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাইয়ে কাউন্সিলরদের ওই অর্থে কোনো ক্ষমতাই নেই, যেখানে শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাইয়ে ভোটাভুটিরও প্রয়োজন হয় না, সেখানে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্র তৃণমূলের দিকে তাকিয়ে থাকবে বা তৃণমূলের মতামতকেই গুরুত্ব দেবে, সেটি ভাবার কী কারণ থাকতে পারে?
সমস্যা আরও এক জায়গায়, আর তা হলো স্থানীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকারে কেন্দ্রের খবরদারি।এর বড় কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন নয়। যে কারণে তারা শক্তিশালীও নয়। কারণ তারা এখনও নিজেরা আয় করে খুব কম। ফলে ব্যয়ের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের ওপর। আর যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের পয়সায় সে চলে, অতএব কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারের ওপর খবরদারি অব্যাহত রাখেন। ফলে সিটি করপোরেশন তো দূরে থাক, এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও হচ্ছে দলীয় প্রতীকে এবং স্বভাবতই কেন্দ্র সেখানে নাক গলায়। স্থানীয় নির্বাচন নিয়েও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জাতীয় রাজনীতি। বিশেষ করে যখন সেখানে শামীম ওসমানের মতো ব্যক্তিদের স্বার্থ থাকে।
কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যদি প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীন ও শক্তিশালী হতো, তাহলে সেখানে কেন্দ্রের এত খবরদারিরও প্রয়োজন হতো না বা তৃণমূল কার নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠালো কি পাঠালো না, তা নিয়েও এত হুজ্জত লাগত না।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, স্থানীয় সরকার সম্পর্কে সরকারের ভেতরেই সবসময় পরস্পরবিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এমপি-মন্ত্রীরা মুখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার কথা বলেন, পক্ষান্তরে তারাই আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে শক্তিশালী না হয়, বিকশিত না হয়, সেজন্য পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়ে গেলে সংসদ সদস্যদের খবরদারি কমে যাবে এবং তাদের তখন আইনত আইন প্রণয়ন এবং নীতিনির্ধারণ ছাড়া কোনো কাজ থাকবে না।
১৯৯২ সালের ৩০ জুলাই কুদরত-ই ইলাহি পনির বনাম বাংলাদেশ ৪৪ ডিএলআর (এডি) ৩১৯ নম্বর মামলায় সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ বলেন, স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা স্থানীয় বিষয়াবলির ব্যবস্থাপনা করা। যদি সরকার কিংবা তাদের আজ্ঞাবহদের এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য আনা হয়, তাহলে এগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না। আদালত আরও বলেন, সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত। কিন্তু তারা স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য নির্বাচিত নন।
কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। আর সেই ভিন্ন বাস্তবতার কারণেই নারায়ণগঞ্জ একটি সিটি করপোরেশন হলেও সেখানের নির্বাচন নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহ। সারা দেশের মানুষের আগ্রহ শামীম ওসমানকে নিয়ে। আগ্রহ সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নিয়ে। তাই আগামী ২২ ডিসেম্বর এখানে যে নির্বাচন হবে, তার আগেই অনেক নাটকীয়তা দেখার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি।এমনকি নাটকীয়তা বা চমক আসতে পারে নির্বাচনী ফলাফলেও।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)