‘তাহেরকে হত্যার লক্ষ্য ঠিক করে বিচার সাজান জিয়া’
উল্লেখিত বক্তব্য আপনার বা আমার আরোপিত কোনো কথা নয়। এ কথাটি স্বয়ং আদালতের। ২০১১ সালের ২২ মার্চ মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, কেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম তাহেরকে জিয়াউর রহমান বিচারের নামে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালে বিচারপতি এএইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের প্রদত্ত রায়ে বলা হয় এই বিচার অবৈধ। রায়ে বলা হয় তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার তাহেরকে বিচারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। রায়ে আরও বলা হয়েছিল তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে পাশাপাশি কথিত সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে হবে।
তাহেরের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর সামরিক ঐ বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন এবং আরেক ভাইয়ের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ। এ ছাড়া আরও দুটি রিট করেছিলেন তাহেরের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সঙ্গী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ দুজন। আরেকটি করেন মেজর জিয়াউদ্দিনসহ আরো দুজন। শেষ রিটটি করেন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ।
১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই রায়ের পর ২১ জুলাই ভোরে যুদ্ধাহত সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৭ জুলাই বিকেলবেলা মামলার রায় হয় আর ২১ জুলাই তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েম মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের কাগজে সই করেন। তাহেরের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২১ জুলাই ছিল তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, সিপাহী জনতার অভূত্থানের নায়ক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সহাসভাপতি কর্ণেল (অব.) আবু তাহের বীরউত্তমকে তথাকথিত গোপন মামলার রায়ে ফাঁসি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাহেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথিত অভিযোগ আনা হয়েছিল। কথিত অভিযোগে তাহেরসহ অন্যান্যদের এক গোপন বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। গোপন বিচারে তাহেরের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় এবং জাসদের অপরাপর নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা সিরাজুল আলম খানসহ মেজর (অব.) জলিল, হাসানুল হক ইনু, মেজর (অব.) জিয়া, কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেনসহ অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়।
২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের হত্যাকান্ড সম্পন্ন করার আগে তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের বিচার করা হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। অনেকটা তড়িগড়ি করে এই সাজানো মামলায় রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা হয়েছিল। শুধু এই নয়, তাহেরের কবরে পর্যন্ত সেনা পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন তৎকালীন সেনা প্রধান। বীরউত্তম তাহেরের হত্যাকান্ড ত্বরান্বিত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। যিনি ৭ নভেম্বরের ঘটনায় তাহেরের কারণেই নিজের জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বীরউত্তম তাহেরের মতো একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার নিকৃষ্টরুপ দেখিয়েছিলেন।
তাহের ছিলেন আপাদমস্তক দৃঢ়চেতা এক সাহসী মানুষ। এ কারণেই পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়ার পরও রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থী না হয়ে বরং উচ্চ কণ্ঠে বলেছিলেন-‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনের মূল্যবান সম্পদ আর কিছু নেই’। কোনো অবস্থাতেই তিনি কারো কাছে ক্ষমা প্রার্থী হবেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তাহেরের পরিবার এমন কী তার মা আশরাফুন্নেসার পক্ষ থেকে তাহেরকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি একবারের জন্যেও সে পথে পা বাড়াননি বরং বরাবরই তিনি নিজের সাহসী সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন অকপটে। তিনি বলেছিলেন মৃত্যুতে তিনি বিন্দুমাত্র ভয় করেন না, ইতিহাস একদিন তাকে মূল্যায়ন করবেই। আর এ কারণেই বিপ্লবী তাহের দৃঢ়তার সাথে নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় পড়ে সারাবিশ্বে মুক্তিকামী মানুষের জন্যে এক অনন্য নজির স্থাপন করে যান।
কর্নেল তাহের এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়তে যেখানে শ্রেণীবিভেদ থাকবে না। এ কারণে ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের দিকে তিনি কখনই ধাবিত হননি। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগও করেছিলেন তাঁর নিজস্ব দর্শন নিয়ে। সেনাবাহিনীকে তিনি পিপলস আর্মীর আদলে গড়তে চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর যোগ দেওয়াটাও ছিল অসাধারণ এক সাহসের বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কর্নেল তাহের পাকিস্তানে আটকা পড়েন। কিন্তু অদম্য এই সাহসী মানুষ মেজর মঞ্জুর, কর্নেল পাটোয়ারী এবং কর্নেল জিয়াকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। শুধু এই নয়, কামালপুরের যুদ্ধে তিনি মারাত্মক আহত হলে তার একটি পা কেটে ফেলে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাহের আসামান্য সাহসের পরিচয় দিয়ে সবার প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। শুধু এই নয়, তাহেরের পুরো পরিবারই মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রেখে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন।
এ কথা সত্য যে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তীতে ২ ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা এবং ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী তাহের পরাস্ত হন মূলত বিদেশী শক্তি এবং জিয়াউর রহমানের কূট কৌশলের কাছে। অথচ কাছ থেকে যারা ৭ নভেম্বরের ঘটনা অবলোকন করেছেন তারা সবাই জানেন কর্নেল তাহেরই সিপাহী বিপ্লবের মূল নায়ক। তাঁর নেতৃত্ব এবং চেতনার সাথে সংহতি প্রদর্শন করেই সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। নানা ঘটনার নাটকীয়তায় জিয়াউর রহমানের জীবনও রক্ষা করেছিলেন আবু তাহের। কিন্তু পরবর্তীতে ইতিহাস লেখা হয়েছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তাহের জিয়াউর রহমানের জীবন রক্ষা করলেও তিনি চরম বিশ্বাস ঘাতকতার পরিচয় দিয়ে তাহেরকে হত্যা করেন। আর তাহের ঘাতকের কাছে মাথা নত না করার দৃঢ়তা দেখিয়ে প্রকৃত বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন।
জিয়াউর রহমান কেন গোপন বিচারের মাধ্যমে তাহেরকে হত্যা করেছিল এ বিষয়টি এখন আর কারো অজানা নয়। বিপ্লবী তাহেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় তাঁর নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। জিয়াউর রহমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহযোগিতায় সে কাজটি ভালোভাবেই করতে পেরেছিলেন।
কর্নেল তাহেরের সাহসী জীবনদান এবং তার সংগ্রামী জীবন অনবদ্য এবং অতুলনীয়। পৃথিবীতে এভাবে জীবনদানের নজীর খুব কমই রয়েছে। তাহের ইচ্ছে করলেই জিয়াউর রহমানের সাথে আপোষ করতে পারতেন। নিজের জীবন রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যা বিশ্বাস করতেন, যে দর্শন ধারণ করতেন তিনি তার প্রমাণ রেখে যান। বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানের সাথে কোনো ধরনের আপোষরফা তিনি করেননি। কিন্তু এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বারবারই তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে নানামাত্রায়।
সম্প্রতি কিছু গেজেল লেখক-গবেষক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এবং বিশেষ প্রকল্পের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বীর উত্তম তাহের সম্পর্কে নির্লজ্জ মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। সেই মিথ্যাচারে তারা খুঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে বীর উত্তম তাহেরের সংযুক্তিকে প্রমাণ করা। এ কথা সত্য তাহের আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন না, কিন্তু তাহের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের শতভাগ সমর্থক ছিলেন। আর এ কারণে তাহেরের কিছু নিজস্ব চিন্তাও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরির সেই চিন্তার সবটুকুই তিনি বঙ্গবন্ধুকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।
ফাঁসি হওয়ার তিনদিন আগে তাহের আব্বা, আম্মা, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছিলেন-আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।’
চরম সত্য কথা তিনি বলে গেছেন ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে। সেই সত্য যেনো আরও উদ্ভাসিত যখন দেখি নতুন নতুন চক্রান্তকারীরা বর্তমানে বিভিন্ন ছদ্মাবরণে বীরউত্তম তাহেরকে হেয় করার জন্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন। আসলে ইতিহাসের এরকম সাহসী একজন মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করা যায় না। যারা এরকম চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে বীরউত্তম তাহেরের ভাষায় বলতে হয়- তারা ক্ষুদ্র ছাড়া আর কী। স্মরণ করিয়ে দিই- গোপন বিচারে রায়ের দিন বিচারকের উদ্দেশ্যে তাহের বলেছিলেন- আই হ্যাভ সিন মেনি স্মল পিপল ইন মাই লাইফ, বাট নেভার ওয়ান স্মলার দ্যান ইউ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)