এর আগেও তো কত কবির কত কবিতা পড়েছি। কত রকম অনুভূতি হয়েছে। কখনও ইচ্ছে হয়েছে উড়তে। কখনও মন চেয়েছে প্রেমে পড়তে। কখনও উদাসী হয়েছি। কখনও নিছকই চুপচাপ বসে থেকেছি। কখনও নাম না জানা কোনো অচিনপুরে হারিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এমন তো কখনও হয় নি। এ কেমন অনুভূতি? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কেমন বিবশ বিবশ লাগে। মেয়েরা প্রথম ঋতুমতী হলে কি এমন অনুভূতি হয় কিংবা প্রথম প্রেমে পড়লে কি এমন লাগে? না বোধহয়। এরসঙ্গে যেন কিছুই মেলে না। মিলতে পারে না। এ এক ব্যাখ্যাতীত অনভূতি। কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
এই কবিতা পড়লে বোধের মধ্যে কেমন কেমন করে। ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/খেলা করে’। এর উপমা, এর উৎপ্রেক্ষা, এর চিত্রকল্প একদমই অন্যরকম। কেমন যেন আবেশ ছড়িয়ে দেয়। আচ্ছন্ন করে রাখে। ডুবিয়ে দেয় আলো-আঁধারির মায়াবী এক জগতে। অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে কখনো কখনো দেখা যায় আলোর রেখা। চেতন আর অবচেতনায় কী যেন দোলা দিয়ে যায়। বেঁধে ফেলে মায়াঘোরে। অনুভূতির তারে তারে বাজতে থাকে নানান সুর। কখনও ছুঁয়ে যায় বেদনা। কখনও বিষণ্নতা। মৃত্যুচেতনাও নয় কি?
এমন লোকাতীত পংক্তি যাঁর অনুভূতিতে সংকুলান হয়েছে, তাঁকেও তো ধরা যায় না। ছোঁয়া যায় না। কোনও নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ রাখা যায় না। তিনি বরাবরই অধরা হয়ে আছেন। যেন অলীক এক ভুবনের বাসিন্দা। বিচরণ করেছেন স্বপ্নালোকে। চির রহস্যময়তা যাঁর কবিতায় এবং যাঁকে ঘিরে রেখেছে অদ্ভুত এক আঁধার, তিনি জীবনানন্দ দাশ। জীবনে যেমন তিনি দুর্বোধ্য থেকেছেন, মৃত্যুতেও হয়ে আছেন বোধাতীত। তাঁকে ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কৌতূহল কখনও নিবৃত্ত হয় না।
তাঁর কবিতা পড়ার পর কিছুই যেন বোঝা যায় না। কেমন অবোধ্য থেকে যায়। দুরূহ দুরূহ লাগে। ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ঠ হয়ে ওঠে। মরীচিকার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। তবুও বার বার পড়তে ইচ্ছে করে। শব্দগুলোর মর্ম ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। একদম গভীরে অবগাহন করতে ইচ্ছে করে। কেন এমন হয়? কী আছে তাঁর কবিতায়? কেউ কি তা অনুধাবন করতে পারেন? কতভাবেই না তাঁকে নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রূপে ধরা দেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় নি। কীভাবে যাবে?
তিনি যে অলৌকিক জগৎ নির্মাণ করেছেন, সেখানে সহজে ঢুকতে পারা যায় না। তিনি শব্দে শব্দে যে চিত্র এঁকেছেন, তা আর কারও পক্ষে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় নি। তিনি রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার মাধুর্য আর কোথাও পাওয়া যায় নি। তিনি যে গন্ধ পেয়েছেন, তা আর কেউ অনুভব করতে পারেন নি। তাঁর অনুভব, তাঁর অনুভূতি, তাঁর অনুধাবন যেন প্রহেলিকাময়। সে অপার্থিব এক জগত। তাতে কুহক আছে। হেঁয়ালি আছে। আছে অধরা মাধুরীও। তিনি তো জীবনের ‘নিভৃত কুহক’কে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তাঁর কবিতার অবগুণ্ঠন পুরোপুরিভাবে উম্মোচন করা যায় না। কুয়াশার মতো একটা আচ্ছাদন তৈরি করে। ‘তারপর দূরে নিরুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায়’।
তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে, তাঁর চৈতন্যের মধ্যে, তাঁর রক্তের মধ্যে যা কিছু প্রবাহিত হয়েছে কিংবা আন্দোলিত করেছে, তাকে শব্দ ও বাক্যের ব্যঞ্জন দিয়ে যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত করেছেন, তেমনটি বোধহয় ‘দেখিব না আর’। কাব্যের মায়াকানন গড়ে তোলার জন্য তিনি যেন কলম-কালি নয়, ঢেলে দিয়েছেন নিজের লহু। যে কারণে তাঁর কবিতা রয়ে গেছে অনধিগম্য, অপ্রাকৃত ও স্পর্শাতীত।
বোধ ও বোধাতীতের কাব্যিক ব্যাখ্যাকার হলেও জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলারও কবি। তাঁর কবিতায় চিত্ররূপময়তা আছে। বর্ণময়তা আছে। রূপকাভাস আছে। তাঁর মতো প্রকৃতিকে এত ব্যঞ্জনাময় আর কে করতে পেরেছে? তিনি ছিলেন প্রকৃতির অতুলনীয় রূপকার। গ্রামের চিরায়ত রূপকে তিনি অবিনশ্বর করে রেখেছেন। যা কখনই হারিয়ে যাবে না।
তাঁর কবিতায় কত কত পাখি। সব চেনা পাখি হলেও তা নিয়ে আসে অন্যরকম ব্যঞ্জনা। চিল, শালিখ, বুনোহাঁস, দোয়েল, বুলবুলি, কোকিল, মাছরাঙা, রাজহাঁস, গাংশালিখ, পায়েরা, খঞ্জনা, ডাহুক, কাকাতুয়া, ঘুঘু, পেঁচা, লক্ষীপেঁচা, শ্যামা, বক, দাঁড়কাক, বাদুর, বউ কথা কওসহ আরও কত কি। এই পাখিরা কতভাবেই না উপমা হয়ে আছে। ‘লক্ষীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?’ আহা! কী যে মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়!
কত কত ফল। চালতা, জাম, বট, কাঁঠাল, হিজল, তমাল, ডুমুর, ধুন্দুল, তালসহ বিচিত্র ফল। প্রকৃতির অকৃপণ সব সম্ভার। তাতে ফিরে ফিরে আসে আবহমান বাঙলার চিরায়ত রূপ। ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে/ভোরের দোয়েল পাখি-চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ/জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;/ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে!/মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ/দেখেছিল’। বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে কি অপরূপ ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃতির এই উপকরণ কখনও বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কবিতায় তার স্বাদ পাওয়া যাবে অন্ততকাল।
ভালোবাসার কত কত অমলিন নারী। অমিতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, বনলতা সেন, শঙ্খমালা, শ্যামলী, সুজাতা, সুদর্শনা, সবিতা, সুচেতনা, সুরঞ্জনারা। হীরের নাকছাবির মতো যেন এক একজন উজ্জ্বলতা ছড়ান। মোহিনী এই নামগুলোতে কী যে মুগ্ধতার আবেশ জড়ানো। তাতে ছড়িয়ে আছে কী যে লাবণ্য। কী যে সৌন্দর্য। কী যে সুষমা। কত স্বপ্ন। কত কল্পনা। কত বিহ্বলতা।
এই নারীরা যেন হয়ে ওঠেছেন ভালোবাসার চিরকালীন প্রতীক। তাদের নিয়ে কত অভিব্যক্তি। কত অভিমান। কত অভিলাষ। ‘অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?/অমিতা নিজে কি তাকে?’। তাদের মতো কতজনকে নিয়েই তো এমন কৌতূহল হয়? অনেকের স্মৃতিতে চকিতে ভেসে ওঠে অরুণিমার মতো অনেকের মুখ। একান্ত কোনও মুহূর্তে ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ’। শঙ্খমালাকে ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’। শ্যামলী! ‘তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন’। নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন, কোনও সুজাতাকে কি ভালোবাসতাম না? ‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি-/এখনো কি ভালোবাসি?’। কত সুদর্শনাকে নিয়ে আফসোস হয়। ‘এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন/তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;/সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে/সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।’ সবিতাকে অকপটে বলা যায়, ‘মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোনো এক বসন্তে রাতে’। সুচেতনা! ‘তুমি এক দূরতর দ্বীপ’।
আর সুরঞ্জনা? কী যে ছন্দিত নাম। হৃদয়ে ঢেউয়ের মতো দোলা দিয়ে যায়। এমন প্রিয়তমাকে কি কখনো ভুলতে পারা যায়? অনন্ত আক্ষেপ নিয়ে অনেকের জীবনেই আছেন এক একজন সুরঞ্জনা। তার অধিকার কোনও একনিষ্ঠ প্রেমিক কখনই ছাড়তে পারবে না। ‘ওই যুবকের’ সঙ্গে কথা বলা নিয়ে বুকের মধ্যে কী যে তীব্র তোলপাড় হয়? এটা কিছুতেই মানতে পারা যায় না। কেউ কি তা পারে? তার ফিরে আসার জন্য কী যে আকুতি? সে কথা কি সুরঞ্জনারা জানে? জানে না বলেই জীবনানন্দ দাশের এমন আকুলতা, ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,/বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;/ফিরে এসো সুরঞ্জনা/নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;/ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;/ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;/দূর থেকে দূরে – আরো দূরে/যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর।/কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!’
আর পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে তাকানো নাটোরের বনলতা সেন? তাকে নিয়ে তো রহস্যময়তার শেষ নেই। আমাদের কল্পনাকে তুমুলভাবে উসকে দেয়। তাকে পাওয়ার জন্য মনটা কি যে আকুলি-বিকুলি করে। কালজয়ী এই নারী যেন অলৌকিক এক মায়াবী জগৎ গড়ে তুলেছেন। সেই জগতে হয়তো খানিকটা শান্তিও বিলানো হয়। ‘আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। একটুখানি শান্তি পাওয়ার আশায় কল্পনার এই নারীর জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় থাকাই যায়।
নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে মোটেও সংশয় কাটে না। তিনি কখনও গেয়েছেন জীবনের জয়গান। কখনও আরাধনা করেছেন মৃত্যুর। প্রকৃতির বন্দনায় মেতেছেন। তাঁর কবিতায় একাকার হয়ে যায় জীবন, জগত, সমাজ, সময়, সভ্যতা, প্রকৃতি। তাতে একীভূত হয়ে যায় ক্লান্তি, অবসাদ, দীর্ঘশ্বাস, বিষণ্নতা, ধূসরতা। তাড়িত করে নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব আর শূন্যতাবোধ। তাঁর কবিতায় শিশিরের ঘ্রাণ আছে। ঘুমের ঘ্রাণ আছে। এমন অসম্ভব ঘ্রাণ আর কেউ কি পেয়েছে? তীব্র হাহাকার আছে। না পাওয়ার বেদনা আছে। এত বৈচিত্র্য। এত বিচিত্রতা। এত বিচিন্তা। সবটাই যেন মন্থিত হয়ে কুয়াশার মতো ঢুকে যায় বুকের গভীরে। তাতে যে নেশা নেশা ঘোর তৈরি হয়, তার মোহাচ্ছন্নতা কাটিয়ে ওঠা যায় না। অথচ এই আবেশের নির্মাতা চিরকালই অধরা রয়ে যান।
তাঁর কবিতা বুঝতে পারা যায় না। তাঁর জীবন বুঝতে পারা যায় না। তাঁর মৃত্যুও বুঝতে পারা যায় না। জীবনানন্দ দাশ আমাদের কাছে যেন অচেনাই থেকে যান। তবে বুঝতে না পারলেও অচেনা থাকে না তাঁর জীবন। তাঁর জগৎ। তাঁর কবিতা। যে কারণে অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো হয়ে থাকেন ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)