‘আমি একটা মাদ্রাসা পড়া গ্রামের ছেলে। যার ছোটখাটো মাদ্রাসায় আজান দেয়ার কথা অথবা মৌলবি হওয়ার কথা ছিলো। অথচ যে দুর্ভাগা দেশে সিনেমার কোনো স্কুল নেই সে দেশে আমি সিনেমা বানাচ্ছি। আমি সৌভাগ্যবান নই, তো কে সৌভাগ্যবান?’- কোনো ধরনের অসচ্ছতার আশ্রয় না নিয়ে প্রতিনিয়ত এভাবেই নিজের অবস্থান, নিজের দেশ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনায় ডুবে থাকতেন যিনি তিনি তারেক মাসুদ!
তারেক মাসুদ নেই ৭ বছর। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। একই দিনে দুর্ঘটনায় তার সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। তাদের দুইজন ছাড়াও আরো ৩ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুদিনে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ। বিশেষ করে আগামী দিনের তরুণ নির্মাতাদের কাছে তারেক মাসুদ এক স্বপ্নের নাম। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠন তার মৃত্যু দিনে আয়োজন করেছে স্মরণ সভার, কেউ বা আবার এই দিনে তারেক মাসুদের ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন রেখেছে।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় নাম তারেক মাসুদ। তার মৃত্যু দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে চ্যানেল আই পরিবার। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার(১৩ আগস্ট) দুপুরে চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত আয়োজন ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় তারেক মাসুদের দুই কাছের মানুষকে। একজন নির্মাতা আবু সাইয়ীদ এবং অন্যজন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।
তারেক মাসুদের কাজ কর্মের সাথে নিবির যোগাযোগ ছিলো এই দুই নির্মাতা ও অভিনেত্রীর। নির্মাতা আবু সাইয়ীদ ছোট ভাইয়ের মতো হলেও তারেক মাসুদ তাকে বন্ধুর চোখেই দেখতেন। এমনকি আবু সাইয়ীদ যখন সিনেমা নির্মাণ করেন, তখন তারেক মাসুদ তাকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেন। তারেক মাসুদের মৃত্যুদিনে নির্মাতা আবু সাইয়ীদ এসব কথা অকপটে বলেন।
আমেরকিায় বসে আরাম আয়েশে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন তারেক মাসুদ। কিন্তু সিনেমার প্রতি প্রেম থেকে সে পথে না গিয়ে স্ট্রাগলের পথ বেছে নিয়েছিলেন জানিয়ে আবু সাইয়ীদ বলেন, তারেক মাসুদ যখন আমেরিকায় গেলেন, তখন অনেকেই ভেবেছিলো সে বোধহয় আর ফিরবেন না। কারণ সেখানে ক্যাথরিনের পরিবারের সাথে ভালোই ছিলেন। তাদের পরিবার যথেষ্ঠ আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন ছিলো। কিন্তু তারেক মাসুদ সেখানে থাকেন নি। তারেক মাসুদ জানতেন, আমেরিকায় থেকে আরাম আয়েশে থাকলেও কখনো তার ফিল্ম করা হয়ে উঠবে না। কারণ যিনি ডিরেক্টর তিনি সব সময় চান তার নিজের ভাষাতেই ফিল্মটা করতে। তিনি জানতেন দেশে ফিরে ফিল্ম বানাতে হলে তাকে প্রচুর স্ট্রাগল করতে, এটা মেনেও তিনি দেশে ফিরছেন। দেশে এসেই সিনেমা বানিয়েছেন। স্ট্রাগল করেই বানিয়েছেন।
কথার ফাঁকে তারেক মাসুদের স্ট্রাগল জীবনের কথা বলেন তিনি। বলেন, এই সময়ে এসে তারেক মাসুদের ব্যক্তিগত স্ট্রাগলের গল্প বলা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ জানি না, তবু বলি। আমরা তখন একসাথে অনেকেই। হোটেল গাবতলী নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। সেখানে আমরা কয়েকজন দুপুরের খাবার খেতাম ১৩ টাকা দিয়ে। এটা ছিলো আমাদের নিয়মিত রুটিন। এরচেয়ে বেশি খরচ করার মতো সামর্থ তখন আমাদের কারো ছিলো না। এখানে যারা ছিলাম তাদের কারোরই কিন্তু আর্থিক দৈন্যতা থাকার কথা ছিলো না। আমরা যদি ফিল্ম বাদ দিয়ে অন্যকিছু করতাম তাহলে এমনটি তখনও কারো হতো না। সিনেমা করবেন বলে এই কৃচ্ছতা সাধন যারা করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম একজন ছিলেন তারেক মাসুদ। অনেক পরে এসে হয়তো ফিল্ম নিয়ে একটু স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করেছেন, কিন্তু তারেক মাসুদ সারা জীবন স্ট্রাগল করে গেছেন সিনেমার জন্য।