সব সেক্টরের মতো নির্মাণ সেক্টরে নারীরা আজ প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞাপন, নাটক এমনকি সিনেমা সব মাধ্যমে নিজেদের মেধা ও দক্ষতার পরীক্ষা দিয়ে আজ তারা যোগ্য নারী নির্মাতা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে চ্যানেল আই অনলাইন সেসব সফল নারী নির্মাতাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছে পুরুষকেন্দ্রিক মিডিয়ায় কীভাবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছেন, আর তাদেরকে কী ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়।
নির্মাতা নুজহাত আলভি অাহমেদ
বর্তমানে ভালো লাগার জায়গা হলো নির্মাতা মানে নির্মাতাই বলা হচ্ছে। নারী-পুরুষ আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ একজন পুরুষ নির্মাতাকে যে সুবিধা-অসুবিধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ঠিক তেমনি একজন নারী নির্মাতাকে সেভাবেই যেতে হয়। একরকম প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার কারণে যে যার মেধা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি যার যার কাজের ধরণ একেক রকম এবং ভাবনার জায়গাও একটু ভিন্ন। একজন পুরুষ নির্মাতা তার চোখে যেভাবে দেখে, সেভাবে হয়তো নারী নির্মাতা তার চোখ সেভাবে দেখেন না। তাই কাজের ভিন্নতা সবাই বুঝতে পারে।
নারী নির্মাতা বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো সমস্যায় পড়েনি। কারণ নিজের মেধা দিয়ে কাজ করছি। নারীরা তাদের ঘরের মতো তাদের প্রোডাকশন সামলাতে পারেন। তবে আমার কাছে যা মনে হয়, মিডিয়ায় টিকে থাকতে হলে নারীদের সবক্ষেত্রে প্রমাণ দিতে হবে তিনি সব কাছে যোগ্য, পুরুষকে কিন্তু সেই প্রমাণ দিতে হয় না। অবশ্য এটিকে আমি সাধুবাদও জানাই। পরিবারে যেমন ভালো বউ, ভালো সন্তান হওয়ার জন্য প্রমাণ দিতে হয়, ঠিক তেমনি ভালো নির্মাতার হওয়ার জন্য ভালো কাজের প্রমাণ দেওয়াও ভালো।
নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওন
একটা সময় সমাজে গোড়ামি ছিল, ছেলে ও মেয়েদের কাজ ভাগ করে দেওয়া হতো। তারা ধারণাই করেছে, মেয়েরা বাইরে পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে না। তবে আমি একজন নারী হিসেবে মনে করি, নারীরা সৃষ্টিশীল কাজে পুরুষদের চেয়ে অনকে বেশি পারদর্শী। যারা কর্মজীবী নারী তারা বাইরের কাজের সঙ্গে ঘরের কাজও সমানভাবে সামলাতে পারেন। ঠিক তেমনি একজন নির্মাতা ঘরের সঙ্গে তার শুটিংয়ের পুরো কাজ এক হাতে সামলান। কোন সময় কোন জিনিসটি প্রয়োজন, তিনি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারেন। তাছাড়া নারীরা মমতাময়ী। সে কারণে নির্মাণের কাজটি তারা খুব গুছিয়ে ও ভালোবাসা দিয়ে করতে পারেন।
নির্মাণের জায়গা থেকে অনেক ধরণের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রগতিশীল রূপে সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যারা আদিকালের সেই ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাস করেন। এখনো নারীদের সব থেকে যে বৈষম্যের শিকার হতে হয়, সেটি তার পোশাক। পোশাক দিয়ে কেন একজন নারীকে বিবেচনা করা হবে, সেটি এখনো নির্মাতা হিসেবে আমার পরিস্কার নয়। একজন নির্মাতা তার মেধা দিয়ে নির্মাণ করবেন, সেখানে কেন তার পোশাক নিয়ে কথা হবে। আরও একটি সমস্যমার মধ্যে প্রায় সবার যেতে হয়, কোনো কিছু না জেনে না বুঝে একজন নারীর বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যেটি একজন নারীর জন্য খবুই অপমানজনক।
নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী
মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতায় নির্মাণের জায়গায় আজ প্রতিষ্ঠিত নারীরা। সব সেক্টরে যেমন নারীরা মেধা-বুদ্ধি ও সাহসীকতা দিয়ে পুরুষদের সঙ্গে কাজ করছে, ঠিক তেমনি নির্মাণের ক্ষেত্রে নারীরা তাদের মেধার পরীক্ষা দিয়ে তাদের জায়গাটি করেছে। নির্মাণে কোনো ‘নারী কোটা’ নেই, যারা কাজ দেখিয়ে নিজের যোগ্যতা দক্ষতা প্রমাণ করতে পেরেছেন, তারাই কাজ করছেন। কোনো বাড়তি সুবিধা নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই এই সেক্টরে। তাই আমি একজন নির্মাতা হিসেবে মনে করি, যারা আজ নির্মাণে কাজ করছেন, তারা নিজের যোগ্যতায় কাজ করছেন।
কাজ করতে গেলে সব সেক্টরে কোনো না কোনো প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তেমনি একজন নির্মাতার অনেক প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকতে হয়, কিন্তু আমার মনে হয় এগুলোকে যদি জীবনের একটি অংশ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেটিই সাহসীকতা। কারণ কোনো কিছু নির্মাণ করতে গেলে নানা ধরণের সমস্যা আসতে পারে, সেই সমস্যা দেখে যদি কেউ পিছিয়ে যায়, তাহলে তাকে হেরে যেতে হয়। সমস্যা যদি আপন করে নিয়ে নির্মাণ করা যায়, তাহলে ওই কাজটি বেশি ভালো হয়।
নির্মাতা নার্গিস আক্তার
নির্মাণের কাজটি আমার কাছে কখনো মনে হয়নি এটি শুধুমাত্র পুরুষদের কাজ। কারণ এই কাজটি করতে কায়িক পরিশ্রম, মেধা ও কারিগরি জ্ঞান সবকিছুই নারীর মধ্যে আছে। তাই আজ নারীরা নির্মাণে কাজ করছে। তবে এই সেক্টরে এখনো তুলনামূলক অনেক কম কাজ করছে, তার একটিই কারণ পারিবারিক শিক্ষা। পরিবার থেকে মেয়েদের বলে দেওয়া হয় পড়াশুনা করার পর কোনো অফিসের ডেস্কে কাজ করতে হবে, বাইরে তার সন্তান বা তার বোন কাজ করবে এটি মেনে নিতে পারেন না। আমার দেখা অনেক মেয়েরা আছে যারা ভালো গল্প লেখে, ভালো প্রোডাকশন তৈরি করতে পারে। শুধুমাত্র পরিবারের আপত্তির জন্য তা তারা করতে পারছে না।
ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষের জায়গা মেধা ও দক্ষতা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে কোনো সমস্যা আর সমস্যা থাকে না। আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বলতে পারি, সাতটি চলচ্চিত্র নিজের দক্ষতায়, যোগ্যতায় নির্মাণ করেছি। এর মধ্যে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে, যখনই কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেছি, তখন অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়েছি, কিন্তু কখনো কাজ থেকে সরে যায়নি। কারণ কাজের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। পুরুষকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছি যে স্বেচ্ছায় সরে না গেলে কেউ সরাতে পারবে না।