চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তারাবিহ নামাজের বিস্তারিত

ইসলামের পঞ্চমস্তম্ভের প্রথম কালেমা বাদে পরের দুটি নামাজ ও রোজা। উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। রমজান মাসে নির্দিষ্ট কিছু সুন্নাত আমল রয়েছে, যার প্রতিটি বিশেষ কোন দিক থেকে হয়ত বৈচিত্র্যর, কিংবা পৃথক বৈশিষ্ট্যের। বান্দার প্রতি স্রষ্টার পক্ষ থেকে এই মাসের বিশেষ উপহার তারাবিহ নামাজ।

তারাবিহ নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবিহ নামাজকে সুন্নত করেছি; অতএব যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের দিনে রোজা পালন করবে এবং রাতে তারাবিহ’র নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এরূপ পবিত্র হবে, যেরূপ নবজাতক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়। (সুনানে নাসাঈ)।

তারাবিহ শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলো তারবিহাতুন, যার অর্থ বিশ্রাম নেওয়া, বিরতি দেওয়া ও প্রশান্তি লাভ করা। শরীয়তের পরিভাষায়, ‘রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নত নামাজ কায়েম করা হয়, সে নামাজই তারাবিহ’। (কামুসূল ফিকাহ)। চার রাকাত অন্তর অন্তর বিশ্রাম সহকারে এ নামাজ আদায় করতে হয় বলে একে ‘তারাবিহ’ নামকরণ করা হয়েছে।

তারাবিহ’র নামাজ সুন্নত হলেও নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ এতে রয়েছে ক্ষমার ঘোষণা ও মুক্তির সুসংবাদ। রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় তারাবিহ’র নামাজ আদায় করবে, তার জীবনে কৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।

বিশ রাকাত সহকারে পড়তে হয় এই নামাজ। এটাই সুন্নাত পদ্ধতি। সাহাবায়ে কিরামের আমলও ছিল তাই। আট রাকাত আদায়ের যে বর্ণনাগুলো হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, তার সবই তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারে; তারাবিহ সম্পর্কে নয়। তারাবিহ নামায বিশ রাকাত হওয়া সংক্রান্ত বিশুদ্ধ অনেক বর্ণনা হাদিসের গ্রন্থসমূহে আছে।

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকেই জামাতসহ বিশ রাকাত আদায়ের পদ্ধতি চলে আসছে। হযরত সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা:) হতে বর্ণিত, ‘হযরত ওমর (রা:) এর যুগে সাহাবায়ে কিরাম বিশ রাকাত তারাবিহ পড়তেন। তিনি আরো বলেন: তারাবিহ নামাজে তারা শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সুরাসমূহ তেলাওয়াত করতেন এবং উসমান (রা:) এর যুগেও দীর্ঘ নামাজের কারণে তাদের লাঠির ওপর ভর করে দাঁড়াতে হত’। (সুনানে বায়হাকী)।

এই হাদিসের সনদ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাসান ফারয়াবী (রা:) বলেন: ‘এর সনদ ও বর্ণনাকারীগণ সকলে শক্তিশালী’। (কিতাবুস সিয়াম)।

অপর বর্ণনায় রয়েছে, সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা:) বলেন: ‘আমরা হযরত ওমরের যুগে বিশ রাকাত তারাবিহ এবং বিতর পড়তাম’। (সুনানে বায়হাকী)। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে আবু যুবাব (রা:) হতে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা:) এর যুগে তারাবিহ ছিল (বিতরের ৩ রাকাতসহ) ২৩ রাকাত’। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)। হযরত হাসান (রা:) হতে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা:) লোকদেরকে একত্র করলেন হযরত উবাই ইবনে কাব (রা:) এর পেছনে। তখন তিনি তাদের ইমামতি করে বিশ রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (সুনানে আবু দাউদ)।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘সাহাবী উবাই ইবনে কাব (রা:) রমজানে মদিনার লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবিহ এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন’। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)।

প্রখ্যাত তাবেয়ী আব্দুর রহমান সুলামি (রা:) হতে বর্ণিত, আলী (রা:) রমজানে হাফেজদের ডাকেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবিহ পড়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, আলী (রা:) তাদের নিয়ে বিতরও পড়তেন’। (সুনানে বায়হাকী)। অন্য এক রেওয়ায়েতে এসেছে, ‘আলী (রা:) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবিহ পড়েন’। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)।

এইভাবে তারাবিহ’র নামাজ বিশ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের ইজমা সাব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই বিরোধিতার কোন সুযোগ নেই। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (র:) বলেন: তারাবিহ’র নামাজ বিশ রাকাত, এ বিষয়ে সকল সাহাবি ইজমা তথা একমত হয়েছেন। (মিরকাত)। আট রাকাতের কথা বলে যারা সহস্র বছর ধরে চলে আসা বিশ রাকাতের রীতি থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করতে চান, তাদেরই অতি পরম শ্রদ্ধেয়জন আল্লামা ইবনে তাইমিয়া নিজেই বিশ রাকাত তারাবিহ’র পক্ষে মত দিতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘হযরত উবাই ইবনে কাব (রা:) রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবিহ ও তিন রাকাত বিতর আদায় করতেন, এ বিষয়টি প্রমাণিত। আর অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম এটিকেই সুন্নত বলেছেন। কারণ তা মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কিরামের পদ্ধতি ছিল। এ থেকে কোন বাধাপ্রদানকারীই তাদের বাঁধা দেয়নি’। (মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া)।

সুতরাং তারাবিহ’র নামায বিশ রাকাত, এতে কোন সন্দেহ নেই। সুন্নতসিদ্ধ এই আমলটি কর্তন করে আট রাকাতে কমিয়ে আনলে এর ফজিলত মোটেও বাড়বে না; বরং প্রতিদানে কমতি ও ক্ষতি হবে। তাই প্রত্যেককে চেষ্টা করতে হবে বিশ রাকাত সহকারে তারাবিহ আদায় করার। আর যারাই এর রাকাতসংখ্যা নিয়ে প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে, তাদের হেদায়েত নসীব হোক। আমীন।