চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তরকারিতে আলুর মতো জনগণের ব্যবহার

আমাদের দেশে সাধারণ মানুষকেই জনগণ বলা হয়। শিক্ষিতদের, মধ্যবিত্তদের জনতা বললে ক্ষেপে যান। কিন্তু আমাদের সমাজ জীবনে এই জনগণের ব্যবহার বহুবিধ বা নানামুখী। নানান উপায়ে বা উদ্দেশ্যে এদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এদের ব্যবহার অনেকটা বিভিন্ন ধরণের তরকারিতে আলুর ব্যবহারের মতো, নিরাপদও বটে।

ভোটের সময়: আমি যখন এটা লিখছিলাম তখন সারা দেশে ৯টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ চলছিলো। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, অন্যান্য দলসহ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। অনেকেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি থেকে নমিনেশন চেয়ে পাননি, তাই তারাও প্রার্থী, স্বতন্ত্র। প্রার্থীদের আদর্শ, চেহারা, আচরণে অনেক অমিল আছে। মিল শুধু এক জায়গায়। সবাই বলছেন, ‘আমিই জনগণকে সাথে নিয়ে জয়ী হবো’। পোস্টারেও হয়তো লেখা আছে, অমুক ভাইকে ভোট দিন- ‘প্রচারে এলাকার সর্বস্তরের জনগণ’। এদের কেউ কেউ হয়তো ১০০ ভোটও পাবেন না, কিন্তু তাকে নমিনেশন দিয়েছেন এলাকার জনগণ! মজা না! জনতা নামের অপূর্ব নিরাপদ ব্যবহার।

সরকার: সরকার জনগণের দাবি পূরণ করার জন্য সব কাজ করার কথা। কাগজে কলমে আছেও তাই। ক্ষমতাসীন আর বিরোধীদল মিলেই সরকার। কিন্তু সরকারের সব কাজ কি জনগণের কল্যাণে হচ্ছে? নাকি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কল্যাণেও হচ্ছে। সব কাজে জনগণের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে অবিরত; রক্ষাকবচ হিসেবে। বিরোধী দলের আন্দোলন হলে মাত্রা বুঝে পুলিশ, বিডিআর, আনসার দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। কিন্তু মুখে বলছে জনগণ বিরোধীদলকে প্রতিহত করেছে। বিরোধী দল কোনো কারণে হরতাল বা অবরোধ ডাকলে কর্মসূচী শেষ হবার সাথে সাথে বলা হয়, জনগণ বিরোধী দলের কর্মসূচী প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিরোধীদল: বিরোধীদল ক্ষমতায় আসার জন্য নানা কর্মসূচী নেয়। দাবি পেশ করে নিজেদের সুবিধার জন্য। শেষে বলে এটা জনগণের দাবি। বলে, জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে এই দাবি আদায় করা হবে। সব সময়ই তাদের নিজেদের চিন্তাকে জনগণের চিন্তা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। নিজ দলের কর্মী ছাড়া গ্রামের সাধারণ জনগণের বিশাল অংশ হয়তো বিরোধীদলের দাবির খবরও ঠিকমতো রাখেন না। তবুও বলা হয় জনগণের দাবির কথা।

সরকারের নির্বাহী বিভাগ: জনসেবার জন্য প্রশাসন। আমাদের মতো দেশে আমলারা রাজনীতিকদের চেয়েও ক্ষমতাশালী। তারাই হয় একটা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান। আবার মন্ত্রণালয়ের অধীন থাকে অনেক দপ্তর। তাদের কথায়, সেখানে নিয়োগ হয় জনস্বার্থে। বিভিন্ন স্থানে পদায়ন হয় জনস্বার্থে, জনগণের কল্যাণে। কল্পনা করুন একজন কর্মকর্তাকে এক উপজেলায় ইউএনও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। বলা হয় ‘জনস্বার্থে এই নিয়োগের বা পদায়নের আদেশ দেওয়া হয়েছে’। কল্পনা করি তিনি (ইউএনও) ‘ক’ উপজেলায় খুব খারাপ বা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করলেন। তখন আবার জনস্বার্থে ‘খ’ উপজেলায় বদলি করা হয়। ভাবটা এমন যে, ‘খ’ উপজেলায় কোনো জনগণ নেই! সেখানে জনস্বার্থ বিরোধী কাজের সুযোগ নেই!

এনজিও: এনজিওগুলো তাদের সকল কর্মসূচী নেয় জনস্বার্থে! কম মজুরিতে গরিব জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে উৎপাদন করে চলে নিজেদের আর্থিক মুনাফার উৎসব। কিন্তু ক্যামেরার সামনে ভালো কথা বলতে শিখিয়ে দেওয়া হয় এই জনতাকে, যাতে জনকল্যাণে নতুন প্রকল্পে ফান্ড আসে। গ্রামীণ কুটিরশিল্পের পণ্যের দাম কতটুকু পান গ্রামের গরীব জনতা? জনতার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দামে আরেক ফাঁকি। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে একটি পণ্যের উৎপাদন মূল্য যেভাবে ধরা হয়, সেই হিসেবে ধরলে গরীব কৃষক জনতার কৃষি পণ্যের উৎপাদনে পুরা লস। তবুও লাভের গল্প ফেঁদে চলে এনজিও, আমলাদের, তাদের চামচাদের ব্যবসা। কৃষিতেও মাইক্রোক্রেডিটের সুদের হার জনদরদী শুনলে বমি আসে অনেকের! ‘ট্যাক্স হলিডে’র সুবিধা নিয়ে আমজনতার কল্যাণে ব্যবসা করে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে লুফে নেয় অনেক টাকা, এই এনজিও। ফলে বসে পড়ে সত্যিকারের সব কোম্পানি। কোনো কোনো সময় কর ফাঁকির মামলায় ধরা পড়লে অনেক পরে তা শোধ করেন, কিস্তিতে। তবুও লজ্জা নেই।

ব্যবসায়ী: সরকার কৃষি পণ্য সংগ্রহে জনমুখী সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে। আইনের ফাঁকে পড়ে সেই মূল্য পায় অনেক বড় ব্যাবসায়ীদের স্থানীয় এজেন্ট, কিছু ভাগ পায় খুদে আমলা আর তাদের দোসরগণ। আমজনতা চেয়ে চেয়ে দেখে।   

নিম্নমানের ও ক্ষতিকর উপাদানে পণ্য উৎপাদন করে ব্যবসায়ীদের অনেকেই বেশি দামে বিক্রি করে গরীব জনতার মাঝে, গরীব বসতি এলাকায়। কত উদাহরণ দেবেন! খাদ্যে ক্ষতিকর উপাদান। অন্য পণ্যেরও মান খুব খারাপ। গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টির নামে চলে চরম মিথ্যাচার। কিছুদিন আগে গরীব শিশুদের জন্য তৈরি শিশু খাদ্যে ভেজাল প্রমাণের পরে এক বিখ্যাত ব্যক্তি আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে লজ্জাহীন হাসিতে বললেন, ‘সরকার তাকে আটকাতে পারেনি কারণ দেশের গরীব জনতা তার সাথে আছে’। দেশের গরীব জনতার কল্যাণেই তিনি কাজ করেন। কী চমৎকার উক্তি, প্রাণ শীতল হয়ে যায়।

ব্যাংক: হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বড় লোকেরা পরিশোধ না করলে বা ফেরৎ না দিলে ব্যাংক থেকে আবার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু গরীব কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তার কোমরে দড়ি দিয়ে নেওয়া হয় জেলে। আমাদের দেশের ব্যাংকের আইন খুব জনমুখী। 

বিচার বিভাগ: এটা নিয়ে কথা বলে জেলে যেতে চাই না। তবে, আদালতের বিচারকগণ জানেন, কে সন্ত্রাসী, কে না। সাক্ষ্য আইনের ফাঁক গলে, দুর্বল চার্জশিটের কারণে সবাই খালাস হয়ে জনতার উপরে চালায় অত্যাচার। ফেঁসে যায় নিরপরাধ জনতা। উনারা নিরপেক্ষ থাকার, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ নিয়ে আদালতে গিয়ে মাঝে মাঝে বিব্রত হন। কিন্তু সাধারণ জনতার জন্য তারা কখনো বিব্রত হন না। তারা টাকার অভাবে, উকিল না নিতে পেরে মাসের পর মাস বিনা বিচারে আটক থাকে জেলে। টাকার লোভে বড় লোকের জেল বাঁচাতে ডামি আসামী হয়ে জেল খাটে গরীব জনতা। 

শিল্প মালিক, পুঁজি গঠনে: বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে শ্রম। আমজনতার শ্রম। এখানে শ্রমবান্ধব, শ্রমঘন শিল্পে চলে শ্রমিকের চরম কল্যাণ!! বেশি বলে লাভ নেই, সব জনকল্যাণে। শিল্প প্রতিষ্ঠার শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য পুঁজি গঠনে চলে নানামুখী গরীব জনতা শোষণ, সরি, ভালোবাসা। যেমন মোবাইল ব্যাংকিং। ব্যাংক চ্যানেলে ২ মিনিটে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে লাগে বড় জোর ৬৫ বা ৮৫ টাকা। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গরীব মানুষেরা (যাদের ব্যাংক একাউন্ট নেই তারা) ২ মিনিটে টাকা আনা নেওয়া করতে পারেন, হাজারে ২০টা চার্জ। মানে ১০ হাজার টাকায় লাগে ২০০ টাকা। খুউব খুউব জনদরদী কর্মসূচী। এভাবে দেখুন শ্রমঘন শিল্পে তাদের ঠকিয়ে সেটা দিয়ে পুঁজি গঠন করা হয়। পরে আবার আমজনতার কল্যাণে শ্রমঘন শিল্পের হয় প্রতিষ্ঠা, একই চক্র। 

বুদ্ধিজীবী: জনগণের কষ্ট দেখলে বুদ্ধিজীবীদের পকেটের টাকা ফুরিয়ে যায়। তাই তারা আমাদের মতো দেশের বড়, মাঝারি বা তাদের ফলোয়ার পাতি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নিজেদের বা নিজস্ব মতকে জনতার মত বলে চালিয়ে দেন পকেট ভরতে বা বড় পদ পেতে। পত্রিকা, রেডিও আর টেলিভিশনসহ নানা মিডিয়ায় চিৎকার চেঁচামেচি করে গরম করে ফেলেন সবকিছু। আসলে সব হয় জনস্বার্থে। তারা যে জনদরদী তাই। এমন অনেক শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী আছে যারা দেশের কোনো সংকটে কোনো কথা বলেন না, দেশেও থাকেন না। তারা দেশের জনগণের কল্যাণে সারা দুনিয়ার পাঁচ তারা হোটেলে ঘুরে ঘুরে জনগণের কষ্টের কথা বলে টাকা যোগাড় করে বেড়ান কার জন্য!

মানবাধিকার সংগঠন, সুশাসন জন্য নিয়োজিত সংগঠন, মিডিয়া সবাই আমজনতার কল্যাণে কাজ করেন! বিস্তারিত বলতে গেলে ১০/২০টা বই লিখতে হবে, কারণ বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ ছাড়া (!) সবাই খুব জনদরদী, গরীব দরদী। তাই তারা সবাই আবার রাজনীতিবিদ হতে চান, সুযোগ পেলে; না পেলেও চেষ্টার কমতি নেই। আমরা চরম ভাগ্যবান যে এমন দেশে জন্মেছি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)