চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কম খরচে বিশ্বসেরা গ্র্যাজুয়েট

‘উদ্ভাবন ও উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে শনিবার ৯৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক শিক্ষাবিদের মতে, রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া তথা জাতি গঠনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অবদান থাকলেও শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলছেন, যদি কম খরচে মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরির কোন র‌্যাঙ্কিং হত তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই শীর্ষে থাকতো।

শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, শুধু দলীয় পরিচয় থাকলে গবেষণা না করেই শিক্ষকরা পদ-পদবী পেয়ে যাচ্ছেন। তাই শিক্ষা কর্মকাণ্ড বা গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তিতেই তাদের বেশি মনোযোগ থাকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আগের সে মান আর নেই। তাদের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের বলেছেন, আত্মতুষ্টি না থাকলেও অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্রদের মান ভালো, যোগ্যতাও বেশি।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি-ঢাবি উপাচার্য
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করলে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান থাকে নিচের দিকে। এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক উঠলেও উপাচার্য মনে করেন, এত অল্প খরচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে মানের গ্রাজুয়েট তৈরি করি সেটা বিশ্বে নজিরবিহীন।

তিনি বলেন, আমরা এক বছর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যে বাজেট বরাদ্দ রাখি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদিনের বাজেটও তার চেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের গ্রাজুয়েটরা যখন বৃত্তি নিয়ে বিশ্বসেরা ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ পায়, তখন দেখা যায় তাদের মান আর আমাদের শিক্ষার্থীদের মান সমপর্যায়ের। কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদেরকেও ছাড়িয়ে যায়। এতেই কি প্রমাণ হয় না এত অল্প খরচেও আমরা কত মানসম্পন্ন গ্রাজুয়েট তৈরি করছি?

নীল-সাদায় ঢাকা পড়েছে ঢাবির শিক্ষার মান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, স্বাধীনতার আগে এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের এক উজ্জ্বল সম্মিলন ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানে ব্যাপক ধস নামে। তার মূল কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, শিক্ষায় ধস নামার মূল কারণ প্রশাসনের রাজনীতিকরণ। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনায় না নিয়ে প্রধান নির্বাহি থেকে শুরু করে সব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাই শিক্ষা ও গবেষণায় তাদের তেমন কোন মনোযোগ নেই, যতটা আছে রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তিতে। তাই স্বভাবতই শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার কথা।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষকের চেয়ে ভোটার নিয়োগ হচ্ছে বেশি। সাদা-নীলের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান।

শিক্ষার মানে ধস নামার বিষয়ে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রকিব উদ্দিন আহমেদ। ষাটের দশকের এ শিক্ষার্থীও মনে করেন, শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষর্থীদের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি অনেকটা দায়ী।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, আমাদের সময়ে শিক্ষক-রাজনীতি ছিল না। তাই শিক্ষকরা শিক্ষা-গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু এখন দেখা যায় রাজনীতির দিকেই শিক্ষকদের মনোযোগ বেশি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পরিমাণ বাড়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের আগের সেই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

‘আমাদের সময় এক ক্লাসে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী ছিলাম ৪০ জন এখন থাকে ২০০। তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আগের সে সম্পর্ক থাকে কী করে?’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মান না থাকলেও একটি অংশ তাদের সময়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জ্ঞান বিজ্ঞানে আমাদের সময় থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়ে নিজেদের তারা অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন।

রকিব উদ্দিন আহমেদ

শিক্ষার্থীদের সুস্থ রাজনীতি চর্চা এবং গঠনমূলক ফোরাম অর্থাৎ ডাকসু সক্রিয় থাকলে সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে তা ভুমিকা রাখতো বলে তিনি মনে করেন।

নেতিবাচক রাজনীতির ছায়া যে শিক্ষার মানে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলছে তা স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তবে তিনি মনে করেন, রাজনীতি সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। কেননা রাজনীতিই একটি জাতির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সে রাজনীতি হতে হবে শিক্ষার স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে তথা সার্বিকভাবে দেশের স্বার্থে। যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কোন স্থান নেই।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, রাজনীতি একটি ইতিবাচক শব্দ। রাজনীতির উদ্দেশ্যই থাকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করা। আর রাজনীতিই যেহেতু একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখে, তাই যোগ্যদেরই রাজনীতিতে আসা উচিত। তাই আমি মনে করি রাজনীতি সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকা উচিত।

‘কিন্তু কেউ যদি রাজনীতির মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে কেবল ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতিকে ব্যবহার করে তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। জাতীয় রাজনীতির মত সে কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই।’

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে যে প্রশ্ন সে প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে আমাদের পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক পিএইচিডি সম্পন্ন করছেন, দেশ বিদেশে গবেষণায় ব্যস্ত রয়েছেন আরও অনেকে। শিক্ষার্থীরাও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্যতার সাক্ষর রাখছে। তাই আমি মনে করি অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন।

কিন্তু এ নিয়ে ন্যুনতম আত্মতুষ্টি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার মান নিয়ে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ একটি পর্যায়ে পৌঁছলে আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে মানের দিক থেকে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

তবে সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মত বলে মনে করেন তিনি।

গবেষণা বিতর্ক
প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘোষণার পর যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয় তা হচ্ছে গবেষণা খাতে বরাদ্দ নিয়ে। আগামী অর্থ বছরের জন্য গবেষণা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট বাজেটের দুই শতাংশ। যাকে অপ্রতুল বলে মনে করেন অনেক শিক্ষাবিদ।

এ ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, বাজেটে যে অর্থ বাজেটের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় সেটা রাজস্ব বাজেট। কিন্তু গবেষণার জন্য জাতীয় উন্নয়ন তহবিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার যে ফান্ড পাওয়া যায় সব মিলিয়ে তা একেবারে অপ্রতুল নয়।