কোটা সংস্কার আন্দোলনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটতে দেখছি। তরুণদের আন্দোলন যা শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হয়ে পুলিশি অ্যাকশনের পর সহিংস রূপ ধারণ করে ও এক পর্যায়ে ভিসি ভবনে তাণ্ডবের ঘটনাও ঘটে, সেই আন্দোলন যখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর পরিণতির পথে তখনই সুফিয়া কামাল হলে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে কেন্দ্র করে প্রথম ঘটনাটি ঘটে।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেমন পরিস্থিতি এখনো কিছুটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তেমনি ভিসি ভবনে হামলার ঘটনাতেও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি। আন্দোলনকারীরা হামলার জন্য অদৃশ্য শক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। উপাচার্য নিজেও বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিসি ভবনে হামলা করতে পারে না। হামলার ঘটনায় পুলিশ তদন্ত করছে। এর মধ্যেই তিন নেতাকে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ‘উঠিয়ে’ নিয়ে আবার ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়টির যেমন সুরাহা হয়নি, তেমনি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনারও। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সবকিছু যখন মোটামুটি একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছিল, তখনই গভীর রাতে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ সভানেত্রী এশা সাধারণ ছাত্রীদের রোষের শিকার হন। অবস্থা এমন পর্যায়ে যায় যে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ রাত ৩টায় এশাকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত জানাতে বাধ্য হয়। হল প্রশাসনও তাকে হল থেকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের কথা জানায়।
পরে অবশ্য জানা যায়, ‘এক ছাত্রীর রগ কেটে দেওয়া হয়েছে’ বলে খবরে ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও সেটি ছিল গুজব। তবে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা এটাও বলেছেন, গত কয়েক বছরে হল ছাত্রলীগ সভানেত্রী সাধারণ ছাত্রীদের ওপর যে ‘মাস্তানি’ করেছেন তার প্রতিক্রিয়া ঘটে ওই রাতে। তারা এটাও বলেছেন, সুফিয়া কামাল হলে যেমন এশা তেমনি অন্য হলগুলোতে অন্য ছাত্রলীগ নেতারা একইরকম ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেছেন যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে অসহায়।
সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমানের বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর নিয়ন্ত্রক ছাত্রলীগ। এশার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং সে ধারাবাহিকতায় কয়েক ছাত্রীকে হল থেকে ‘বের করে দিয়ে অভিভাবকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ ছাত্রীদের সামনে অধ্যাপক রেজওয়ানা যে কথা বলেছেন সেখানেই প্রশাসনের অসহায়ত্ব প্রমাণ হয়েছে।
ছাত্রীদের সামনে তিনি বলেছেন, এখন থেকে হল নিয়ন্ত্রণ করবে হল প্রশাসন, অন্য কেউ নয়। তার এ কথার মানে কী? এ কথার একটাই মানে যে, হল প্রশাসন এখন তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও এতোদিন নিয়ন্ত্রক ছিল অন্য কেউ। সেই অন্য কেউ কে সেটা বর্তমান বাস্তবতায় খুবই স্পষ্ট।
এশার অপমানিত হওয়ার ঘটনায় প্রাধ্যক্ষ বলেন, যারা এ কাজ করেছে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্রীরা তখন সম্মিলিতভাবে জানান, সেটা হলের দুই হাজার ছাত্রীই করেছেন, এবং তারা সেটা তার এতোদিনের আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে করেছেন। ছাত্রীদের সঙ্গে প্রাধ্যক্ষের কথোপকথনের যে অডিও আমরা শুনেছি, তাতে স্পষ্ট যে সেখানে উপস্থিত সকল ছাত্রীই এশার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের ‘অগ্রহণযোগ্য প্রকাশের দায়ভার’ নিচ্ছেন।
তাদের সেই কণ্ঠ খুবই স্পষ্ট এবং আমাদের কাছে একটি সম্মিলিত প্রতিবাদ বলেই মনে হয়। তারা যখন একযোগে বলেন, হলের দুই হাজার ছাত্রীই সেদিন এশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, বহিস্কারের শাস্তি পেতে হলে দুই হাজার ছাত্রীই শাস্তি ভোগ করবেন, তখন এটাই মনে হয়; তারা অন্ততঃ ওই একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ, তাদের মধ্যে সংহতি আছে, তারা গণভাবে একটি চেতনাকে ধারণ করছেন।
তবে, প্রাধ্যক্ষ দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষার্থীদের সেই প্রতিবাদকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার বিপরীতে তাৎক্ষণিক পিষে ফেলার পথ বেছে নেন। তিনি তখন বলেছেন, দুই হাজার ছাত্রীকে তাহলে লিখিত দিতে হবে যে তারা সবাই সে রাতে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে তিনি দুই হাজার ছাত্রীকেই বহিস্কার করে দেবেন।
এটা ভাবা মোটেও ঠিক হবে না যে, প্রাধ্যক্ষ ড. রেজওয়ানা সত্যিসত্যিই দুই হাজার ছাত্রীকে বহিস্কারের কথা ভেবেছেন। দুই হাজার ছাত্রীকে লিখিত দিতে হবে বলে তিনি আসলে ওই ছাত্রীদের হুমকি দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অন্য অনেক জায়গার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও এখন এরকম হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজেদের চেয়ার ঠিক রাখতে হচ্ছে।
আমরা আশা করবো, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনার অন্যতম পুরোধা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের বোধোদয় হবে। নিজেদের পদ-পদবী রক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকাঙ্খার বিপরীতে তারা অবস্থান নেবেন না। ড. রেজওয়ানা ‘এখন থেকে হল প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকবে’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা যদিও তাদের এতোদিনের কলঙ্ক প্রকাশ করে, তারপরও আমরা আশা করবো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই কলঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে এখন থেকে হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রেই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।