বাংলাদেশের মতো উঠতি গণতন্ত্রের দেশে, অর্থাৎ যেখানে গণতন্ত্র বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার মতো; অর্থাৎ দুই হাত উঠলে দেড় হাত নেমে যায় সেখানে বিচার বিভাগের পক্ষে খুব স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা কঠিন।
গণতন্ত্র না থাকলেও, অর্থাৎ একনায়কতন্ত্রের মধ্যেও বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকতে পারে যদি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। কিন্তু বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রিত রেখে বা রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে রেখে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের প্রত্যাশা করা অনুচিত।
আমাদের বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, তা নিয়ে খুব খোলামেলা আলোচনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও আমাদের বিচার ব্যবস্থায় রাজনীতি ও ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে খোদ প্রধান বিচারপতিরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিভিন্ন সময়েই বিচার বিভাগের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছেন। এমনকি তিনি প্রথমে ছুটিতে এবং এরপরে যে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়েছেন, সেখানেও যে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।
এত কথা বলার অর্থ হলো, দ্রুততম সময়ে জনমানুষের নেতা এবং স্বপ্নের কারিগরে পরিণত হওয়া ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুর পর থেকেই তার উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। এই উপনির্বাচনের আলোচনায় তৈরি হয় জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ। প্রধান দুটি দল তাদের প্রার্থীও মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই এরকম একটি গুঞ্জন ছিল যে, এই নির্বাচনটি আদৌ হবে কি না? সচেতন মহলে এই আশঙ্কাও ছিল যে, হয়তো এই নির্বাচন ঠেকাতে একটি রিট হবে এবং উচ্চ আদালত এই নির্বাচন স্থগিত করে দেবেন। অবশেষে সেই ধারণা বা আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো। যদিও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এর পেছনে তাদের কোন হাত নেই।
বাস্তবতা হলো, সব হাত দৃশ্যমান নয়। আবার সরকারের প্রভাবে বা নির্দেশে হাইকোর্ট এই স্থগিতাদেশ দিয়েছেন, এ কথা বলারও সুযোগ নেই। কারণ বিজ্ঞ বিচারকরা যুক্তি-তর্ক শুনেই রায় দেন। এই নির্বাচন স্থগিত চেয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, সেখানে খুব জোরালো যুক্তি না থাকলে বিচারপতিরা কারো মুখে কথায় এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে স্থগিতাদেশ দিতেন না। যদিও ঢাকা উত্তর সিটির এই উপনির্বাচনটি ঠেকানোর প্রচেষ্টা ছিল ওপেন সিক্রেট। ফলে উচ্চ আদালত যখন সত্যিই তিন মাসের জন্য এই নির্বাচন স্থগিত করে দিলেন, সেই সংবাদে অনেকেই বিস্মিত হননি।
গত ১২ জানুয়ারি এই মেয়াদে সরকারের ৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই বছরের শেষদিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। এর আগে অবশ্য মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনেও ভোট হবে। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ঢাকা সিটিতে ভোট আয়োজন করে সরকার কোনও ধরনের ঝুঁকি নেবে কি না– সেই সংশয়ও ছিল। কেননা এই নির্বাচনটি সরকারের জন্য অনেকটা শাঁখের করাতের মতো। নিরপেক্ষ ভোট হলে কোন দলের প্রার্থী জয়ী হবেন, সেই উপসংহারে না গেলেও যদি শেষমেশ এখানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হেরে যান, সেটি নির্বাচনের বছরে সরকারের জন্য একটা বাড়তি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবে। আবার এখানে সরকারি দলের প্রার্থী জিতে গেলে বিরোধী শিবির থেকে, বিশেষ করে বিএনপি বলবে সরকার কারচুপি করেছে। ভোট ডাকাতি করেছে। সুষ্ঠু ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতে গেলেও বিএনপি এই কথা বলতে ছাড়বে না এবং অনেকেই তাদের কথা বিশ্বাস করবে যা জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রত করবে এবং বিপাকে ফেলবে।
যদিও সদ্য শেষ হওয়া রংপুর সিটিতে সরকার দলীয় প্রার্থী হেরে গেছেন। এটি সরকারের জন্য কোন চাপ তৈরি করেনি। কারণ রংপুর প্রথম জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে পরিচিত এবং সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে নিজের দলের এবং ভোটারের দূরত্ব ছিল ঢের। তাছাড়া এখানে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করানোর কোনো চেষ্টা সরকারের ছিল না। ফলে এখানে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। এখানে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গেলেও আখেরে এটি সরকারের ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে। অনেকের মধ্যেই এই বার্তা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে যে,সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু রাজধানীতে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গেলে সেটির প্রভাব তৃণমূলে পড়বে।
মজার ব্যাপার হলো, যে দুজনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ডিএনসির উপনির্বাচনটি স্থগিত করেছেন তাদের একজন বিএনপি নেতা। সুতরাং এই উপসংহারেও পৌঁছানো কঠিন যে, সরকার এই নির্বাচন স্থগিত করতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তবে ঘটনার নেপথ্যে যাই হোক, দুই বছরের জন্য ঢাকা সিটির মেয়র হয়েই যে কেউ এই শহরের চেহারা বদলে দিতে পারবেন, তাও নয়। বরং স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর কথাই যুক্তিযুক্ত যে, এখন ভোট না হলেও ঢাকা উত্তরে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে না। হয়তো হবে না। কিন্তু তারপরও এই নির্বাচনটি স্থগিত হওয়ার বিষয় নিয়ে জনমনে যে আশঙ্কা ছিল, সেটি প্রমাণিত হওয়ার ঘটনাটি গণতন্ত্রের জন্য খুব সুখকর নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)