চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ঢাকার মানুষ আর রসিকতা : হিলসা লে, বাতাসা লে…

রসিক হিসেবে পুরান ঢাকার মানুষের রয়েছে আলাদা খ্যাতি। যাপিত জীবন কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়ে যত্রতত্র রসিকতা করায় এদের কোনো তুলনা হয় না। শত শত বছর ধরে পুরান ঢাকা আর এর মানুষের রসিকতা নিয়ে নানা রকম কিংবদন্তি তুল্য গল্প-কাহিনি প্রচলিত আছে। রসিকতায় পরিপূর্ণ এসব গল্পের ভেতর সে সময়ের সমাজ, বৈষম্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, শ্রেণি বিন্যাসের ভেদাভেদ সব কিছুই উঠে আসত। বিশেষ করে রাজনীতির সঙ্গতি-অসঙ্গতির প্রতি এখানকার মানুষের গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল, সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তারা তাদের মনোভাব প্রকাশ করতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের এসব প্রকাশ মারাত্মক অর্থবোধক আর তির্যক হয়ে উঠত।

শত শত বছর ধরে চলতে থাকা পুরান ঢাকার মানুষজন বংশ পরম্পরায় রসবোধের সেই ধারাটি এখনো তাদের প্রাত্যহিক জীবনে অব্যাহত রেখেছেন। পুরান ঢাকার মানুষের কথাবার্তায়, চালচলনে, অঙ্গ-ভঙ্গি সর্বোপরি জীবনাচরণে যে সূক্ষ্ম রঙ্গ রসিকতা পরিলক্ষিত হয় তা খেয়াল করলে যে কেউই এর মধ্যে খুঁজে নিতে পারেন অনেক সমাধান। জীবনকে অযথা জটিল করে লাভ কি তার চেয়ে একে সাদামাটা হিসেবে দেখলে ক্ষতি কি এরকম এক গভীর জীবন দর্শন পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে কাজ করে।

দুই.
দেশ ভাগের আগের দিককার কথা। পুরান ঢাকার এক বুদ্ধিমান বেড়াতে গেছে কলকাতায়।কয়েকদিন কলকাতায় বেড়ানো-টেড়ানোর পর একদিন সে মাছ কেনার জন্য গেল বাজারে। মাছ বাজারে সে বেশ মাছ-টাছ দেখছে। তার বেশভূষা আর ম্যাকআপ-গেটআপ মাছুয়ার কাছে খুব একটা যুতের ঠেকল না। শুধু তাই নয়, মাছুয়া তাকে দীনহীনও ভেবে বসল।

মাছুয়ার ডালায় বড় বড় ইলিশ মাছ।

ঢাকাইয়া মানুষ তার ওপর চোখের সামনে লোভনীয় ইলিশ মাছ। এও কি সহ্য করা যায়!

ঢাকাইয়া খুব মনোযোগ সহকারে মাছুয়ার ইলিশের সাইজ দেখছিল।

মাছ বাজারে লোকজন আসছে, যাচ্ছে। অন্যরা বেচাবিক্রিও করছে। আর মাছুয়ার দোকানের সামনে এই অযাচিত কোত্থেকে এসে দাম দস্তুরের কথাবার্তা নেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মাছের আকার প্রকার দেখছে।

মাছুয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতার ওপর বিরক্ত হলো। মাছুয়া ক্রেতার হালচাল দেখে তার সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ধারণা নিয়ে তাকে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু সরিয়ে দিতে চাইলেই কি আর সরিয়ে দেওয়া যায়?

কি আর করা!

মাছুয়ার মাথায় একটা ‘ফিচেল মার্কা’ চালাকি খেলে গেল। সে করল কি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাছ-ক্রেতাকে সরানোর কায়দা হিসেবে বেশ গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়তে লাগল,

‘হিলসা লে হিলসা লে ’ এ কথার অর্থ দু’রকম দাঁড়ায়। একটা অর্থ হলো, ইলিশ মাছ নাও। আরেক অর্থ হলো, শালা, মাছ না কিনলে এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়।

ঢাকার মানুষ বলে কথা! সে মাছুয়ার কথার অর্থ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল এবং সে এটাও বুঝতে পারল তাকে শুধু সরে পড়তেই বলা হয়নি উল্টো ‘শালা’ হিসেবে গালিও দেওয়া হয়েছে।

‘হউরের পো’ গালিটা প্রায় গলা অবধি উঠে এলেও চেপে গেল সে। যে করেই হোক এর একটা প্রতিশোধ নিতে হবে ভেবে সে মাছুয়ার দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।

ক্রেতার প্রস্থানে মাছুয়া ভেতরে ভেতরে খুশি। যাক আপদ গেছে।

ঢাকাইয়া সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু দূরের এক দোকান থেকে কয়েকটা বাতাসা কিনে আবার ফিরে এলো মাছুয়ার সামনে।

মাছুয়া তার পুরনো ক্রেতাকে দেখে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় বিরক্ত।

ব্যাটা আবার এসেছে!

ঢাকাইয়ার মুখে স্বস্তির হাসি। এবার সে মাছুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা বাতাসা দেখিয়ে মাছুয়াকে বলতে লাগল,

‘ বাতাসা লে, বাতাসা লে ’

এ কথার অর্থও দু’রকম ভাবে করা যায়। এক রকম অর্থ হলো, শালা বল, ইলিশ মাছের দাম কতো। আরেক রকম অর্থ হলো, বাতাসা নাও, বাতাসা নাও।

মাছুয়া তখন কি আর করবে। সে মাথার ওপর দু’হাত তুলে করজোড়ে ঢাকাইয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাণ করল।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)