ঢাকার তেজগাঁও রেল কলোনির একটি ঝুপড়ি ঘরে কথা হলো দশজন বীরাঙ্গনা নারীর সঙ্গে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকারদের মাধ্যমে তারা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আটক হন। দেশ স্বাধীনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন হেমায়েত বাহিনীর নৌকার মাঝি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী স্বর্ণলতা পলিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
তেজগাঁও রেল কলোনিতে নিজেরা ঘর উঠিয়ে তারা ভাড়া থাকছেন। বীরাঙ্গনা রিজিয়ার ঘরে এক এক করে উপস্থিত হলেন দশজন বীরাঙ্গনা নারী ও উদ্ধারকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা পলিয়ার। দশ বীরাঙ্গনা হলেন, রিজিয়া বেগম, নাজমা আক্তার, নূর জাহান বেগম, রেজিয়া বেগম, রাজিয়া বেগম, রঙ্গমালা, সাবিহা আহমেদ, সন্ধ্যা রানী, কানন গমেজ এবং লুৎফা।
রিজিয়া বেগম বলেন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আবু মিয়া সরকারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তেজগাঁও রেলগেটে আবু মিয়া সরকারের একটা ফলের দোকান ছিলো। আবু মিয়া সরকার একদিন বাসায় না আসায় তাকে খুঁজতে গিয়ে তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বাংলামটর (তৎকালীন সময়ের পাক মটর) জঙ্গলে ফেলে রেখে যাওয়া হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা পলিয়ার সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। বর্তমানে ১৭/১৮ বৎসর ধরে ফকিরনীর বাজারের রেল কলোনিতেই আছেন। এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো ধরণের সহযোগিতা পাননি বলে তিনি জানান।
রিজিয়া বেগম আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাই। সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে আমি চিৎকার করে বলতে থাকি, আমাকে কথা বলতে না দিলে আমি এখানেই মারা যাবো। পরে দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিএসকে আমার কথাগুলো লিখতে বলেন। নাম ঠিকানাসহ পিএস সবকিছু লেখেন।’
বীরাঙ্গনা নাজমা আক্তারের বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলায়। তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বীরাঙ্গনা বলে তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করে আলাদা থাকছেন। নাজমা আক্তার বলেন, ‘সামনাসামনি অনেক সাংবাদিক, নেতা অনেক কিছু বলেন। আড়ালে তারাই সমালোচনা করেন। আমাদের আর আছে কী? আমরা বাঁচতেও পারছি না, মরতেও পারছি না। আমরা মাঝখানে ঝুলে আছি। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা আমাদের ইজ্জত হারিয়েছি।’
নাজমা আক্তার জানান, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার নারিকেল বাড়ির মিশন থেকে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। বীরাঙ্গনা রেজিয়া খাতুনের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলায়, কানন গমেজের বাড়ি বরিশালের আগৈল ঝাড়া উপজেলায়, লুৎফা বেগমের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে।
কানন জানান, তিনি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার নারিকেল বাড়ি মিশনে থাকতেন। ওখানে ইংরেজ ফাদাররা সর্বস্তরের মানুষের জন্য একটি লঙ্গরখানা করে দেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা, যুবক-যুবতীরা আশ্রয় পেতেন। স্থানীয় রাজাকাররা যুবতী মেয়ের সন্ধান পেয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে জানাতো। তিনি, নাজমা আক্তার ও শেফালি বালা নামের মিশনের একজন সিস্টার পাকবাহিনীর হাতে একসাথে ধরা পড়েন।শেফালি বালা বাচ্চা পেটে বিষ খেয়ে মারা যান।
বীরাঙ্গনা রাজিয়া বেগমের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়, রঙ্গমালার বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়, সন্ধ্যা রানী ঘোষের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে ও নূরজাহানের বাড়ি মাদারীপুর জেলার মাদারীপুর সদর উপজেলায়।
কথা হয় এই দশ বীরাঙ্গনাসহ অন্যান্যদের উদ্ধারকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা পলিয়ারের সাথে। বঙ্গবন্ধু, মেজর জলিল ও হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম তাকে পাগলী স্বর্ণলতা বলে ডাকতেন। তিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, আমি বহু কষ্টে এই দশজনকে খুঁজে পেয়েছি। হেমায়েত বাহিনীর নৌকায় উদ্ধার হওয়া আরও ৫০/৬০জন বীরাঙ্গনা ঢাকা মেডিক্যালে ছিলেন। ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে কিছুই জানি না। এদের উদ্ধার করে শাপলা পাতা ও কলাপাতা দিয়ে তাদের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করেছি। আমি এদের ভালবাসি তাই স্বামী সন্তান বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গেই থাকি।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি বীরাঙ্গনাদের সবসময় খোঁজখবর নিতেন। একবার তিনি ১৭৫ টাকা দিলেন তাদের খোঁজখবর নিতে যাওয়ার সময়। কিন্তু বর্তমানে কী দেখছি? আসল মুক্তিযোদ্ধা ভাত পায় না, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আরামে থাকে। দেশের জন্য যারা সম্ভ্রম হারিয়েছে অবহেলা, অপমান, আর দুঃখ-কষ্ট তাদের নিত্যসঙ্গী।
কে আসল কে ভুয়া তা প্রমাণসাপেক্ষে দ্রুত নিস্পত্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা পলিয়ার। সেই সাথে এই দশ বীরাঙ্গনাসহ সব সত্যিকারের বীরাঙ্গনাকে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়ার আহবান জানান তিনি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)