পরের দেড় দশক বীরদর্পে বাংলাদেশ শাসন করা সেনা কর্মকর্তারা ৭৫’র ১৫ আগস্ট মেজর রশিদ আর মেজর ডালিমের স্টেনগানের সামনে শুধু মিঁউমিঁউই করেন নি, ভয়ে পালিয়েও গিয়েছিলেন। এমনকি সেনাপ্রধান কিংবা পরে ২ নভেম্বর পাল্টা ক্যুয়ের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের জন্য বঙ্গভবনের দখল নেওয়া সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলও ১৫ আগস্ট সকালে কোনোকিছু করার সাহস পান নি।
মেজর ডালিমের স্টেনগানের সামনে অফিসারদের অবস্থা কিরকম ছিলো সেটা বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদের সাক্ষ্যে। সেসময় ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন তিনি।
প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি জানান, টেনিস খেলার সময় চাকুরিচ্যুত মেজর ডালিম এবং মেজর নূরকে তারা টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখতেন। এটা তাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতো। কারণ, তারা ছিলো চাকুরিচ্যুত অফিসার। একদিন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে (হামিদকে) বলেন, এরা চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার। এরা কেনো এখানে খেলতে আসে! এদেরকে জানিয়ে দেবেন, এরা যেনো না আসে।
খেলা শেষে মেজর নূরকে কর্নেল হামিদ জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আসো? জবাবে নূর জানায়, জিয়ার অনুমতি নিয়ে তারা খেলতে আসে। বিষয়টি নিয়ে যে আর কোনো কিছু করা হয়নি তার প্রমাণ কর্নেল হামিদের সাক্ষ্য, যেখানে তিনি জানান: ১৪ আগস্ট বিকেলেও টেনিস খেলার সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে মেজর ডালিম এবং মেজর নূর টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘুরঘুর করছে।
মেজর মহিউদ্দিনসহ এই মেজর হুদা পরদিন ভোরে বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি করে। আর মেজন ডালিম বেতার থেকে ঘোষণা দেয়: স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।
কালো সেই সকালের বর্ণনা দিয়ে লে. কর্নেল হামিদ জানান: ১৫ আগস্ট ভোরে অনুমান সকাল ৬টায় কর্নেল আব্দুল্লাহর টেলিফোন পেয়ে রেডিও অন করে তিনি মেজর ডালিমের কণ্ঠে শোনেন যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জেনারেল শফিউল্লাহ টেলিফোনে বলেন: ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্টিলারি আর্মাররা বাইরে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তোমরা কি কিছু জানো? তিনি জানি না বলে রেডিওতে কি শুনছেন সেটা বলেন। ‘যদি কিছু থাকে তা হলে জানাবো,’ বলে তিনি অফিসের উদ্দেশে রওনা হন।
পরে লে. কর্নেল নূর উদ্দিনের অফিসের সামনে জিপ থেকে নেমে তিনি বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মোমিনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
তখনকার বর্ণনা দিয়ে কর্নেল হামিদ বলেন: এমন সময় কালো পোষাক পরা কিছু সৈনিকসহ দুটি জিপ শো-শো করে প্রধান গেট দিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ঢুকে পড়ে। কর্নেল মোমিন হাত দিয়ে ইশারা করে একটি জিপকে থামতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে উন্মুক্ত স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম নেমে পড়ে এবং চীৎকার করে বলে: শাট আপ, গেট অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার।
‘এতে তখন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অফিসাররা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে যে যেদিকে পারলো, ছুটে পালালো,’ উল্লেখ করে হামিদ জানান: মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় সরাসরি জেনারেল শফিউল্লাহর রুমে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পর মেজর ডালিম স্টেনগানের মুখে শফিউল্লাহকে রুম থেকে বাইরে নিয়ে আসে। পেছনে জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ অন্য সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন।
তিনি জানান: সেখানে অপেক্ষমান প্রথম গাড়িতে জেনারেল শফিউল্লাহ উঠেন, দ্বিতীয় গাড়িতে মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় ছিলো। তৃতীয় গাড়িতে জেনারেল জিয়া এবং চতুর্থ গাড়িতে মেজর ডালিমের সশস্ত্র লোকজন ছিলো। চারটি গাড়ির কনভয় এরপর সেনা সদরের আউটার গেট দিয়ে দক্ষিণ দিকে ব্রিগেডে চলে যায়।
কর্নেল হামিদসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যে স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরও সেনা সদর কিংবা ঢাকার ব্রিগেড তাৎক্ষণিকভাবে আর্মি হেডকোয়ার্টার বা ব্রিগেডের নিজস্ব নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থাই নেয় নি। যারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবার হত্যা করতে পারে, তারা যে সেনা সদরেও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের চেষ্টা করবে; সে কথা কেউ ভাবেনও নি। অথচ এর মধ্যেই তিন ঘণ্টা সময় পার হয়ে গিয়েছিলো।
সেনা সদর তাই ছিলো যে কারো ঢুকে পড়ার মতো মুক্ত এক অঞ্চল। যে কারণে সিনিয়র অফিসারদের অল্প কিছু সেনাসহ আসা মেজর ডালিম এবং মেজর রশিদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিলো, কিংবা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে হয়েছিলো। সেদিন এমনই ছিলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেওয়া সেনা কর্মকর্তাদের অবস্থা।
লে. কর্নেল হামিদ যে বর্ণনা দিয়েছেন তার আগে-পরের চিত্র জেনারেল শফিউল্লাহসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যেও পাওয়া যায়। জেনারেল শফিউল্লাহ ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
খোলা স্টেনগান নিয়ে মেজর ডালিমের সেনা প্রধানের অফিস কক্ষে ঢুকে যাওয়ার যে কথা কর্নেল হামিদ জানিয়েছেন, তার পরের চিত্র পাওয়া যায় শফিউল্লাহর বক্তব্যে।
সেসময় তার কক্ষে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বসেছিলেন। শফিউল্লাহ জানান, ৪৬ ব্রিগেডেকে সক্রিয় করার জন্য তখন খালেদ মোশাররফকে তাগিদ দিচ্ছিলেন তিনি।
এইসময় দরোজা ধাক্কা দিয়ে মেজর ডালিম ১০/১৫ জন সৈন্যসহ সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে পড়ে তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলে জানান শফিউল্লাহ। ডালিম চাকুরিচ্যুত অফিসার হলেও সেদিন ইউনিফর্ম পরা ছিলো।
শফিউল্লাহ ডালিমকে বলেন: ডালিম, আমি এই অস্ত্র দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তুমি যদি এটা ব্যবহার করতে এসে থাকো, তা হলে ব্যবহার করো। আর তা না হলে যদি কথা বলতে এসে থাকো, তা হলে তোমাদের সৈন্যদের অস্ত্র বাইরে রেখে আসো।
শফিউল্লাহর ভাষ্যমতে: এরপর ডালিম তার অস্ত্রটি নিচের দিকে মুখ করে বলে, স্যার, প্রেসিডেন্ট ওয়ান্টস ইউ ইন দ্যা রেডিও স্টেশন। শফিউল্লাহ তখন বলেন, প্রেসিডেন্ট তো মারা গেছেন। জবাবে ডালিম বলে, স্যার ইউ শুড নো খন্দকার মুশতাক ইজ দ্যা প্রেসিডেন্ট নাউ। শফিউল্লাহ তখন বলেন, খন্দকার মুশতাক মে বি ইউর প্রেসিডেন্ট, হি ইজ নট মাইন। তখন ডালিম বলে, স্যার, ডোন্ট মেক মি ডু সামথিং ফর হুইচ আই ডিড নট কাম।
শফিউল্লাহর দাবি, এরপর তিনি ডালিমকে বলেন, তোমার যা খুশি করতে পারো। আমি আমার ট্রুপসের কাছে যাচ্ছি।
একথা বলে শফিউল্লাহ অফিস থেকে বের হয়ে ৪৬ ব্রিগেডের দিকে রওনা হন বলে তার সাক্ষ্যে জানিয়েছেন। ডালিমও তার সৈন্য-সামন্ত এবং অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত গাড়ি নিয়ে তার পেছনে যায় তিনি উল্লেক করেন।
শফিউল্লাহ জানান, সেখানে (৪৬ ব্রিগেডে) মেজর রশিদ এবং মেজর হাফিজ তাকে রেডিও সেন্টারে যাবার জন্য চাপ দিতে থাকে। ওই জায়গার পরিবেশ দেখে হতভম্ব হয়ে আর চাপের মুখে শফিউল্লাহ বলেন: ‘আমি একা যাবো না। এয়ার এবং নেভাল চীফের সঙ্গে কথা বলি।’
(আগামীকাল নবম কিস্তি: ১৫ আগস্ট রথী-মহারথীদের অসহায় আত্মসমর্পণ)