ভাইরাস শুরুর কয়েক মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সহযোগীরা নিয়মিত মাস্ক ছাড়াই চলাচল করেছেন। প্রায়ই তাদের আচরণ ছিলো এমন যে, কোনো মহামারী নেই। তারপর প্রেসিডেন্ট করোনা পজিটিভ হলেন। সাথে সাথে বদলে যায় তাদের পৃথিবী। এটি একটি ভূমিকম্প দিনের গল্প বলা চলে!
শুক্রবার সকালে হোয়াইট হাউস থেকে নয় মাইল দূরে ওয়াল্টার রিড সামরিক হাসপাতাল নিরব-নিস্তব্ধ ও শান্ত ছিলো। তবে সবার মনোভাব ভার ছিলো। পুলিশের প্রহরী প্রস্তুত ছিলো। প্রেসিডেন্টকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে, তাই তার হেলিকপ্টার অবতরণের জায়গাটি নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হচ্ছিলো। কেউ নিশ্চিত জানে না আসলে কী হতে চলেছে। এর মধ্যে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার সহকর্মীদের জানানোর চেষ্টা করছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট এর হেলিকপ্টারটি জন্য তাদেরকে কোথায় অপেক্ষায় করতে হবে। কর্মকর্তারা দিশেহারা অবস্থায় পড়ে যাচ্ছিলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এটি হাসপাতালের বাইরে একটি যথাযথ পর্যবেক্ষণ ছিলো এবং একই পরিস্থিতি ছিলো হোয়াইট হাউসেও।
ওয়াশিংটনে শনিবার সকাল ১০ টার ঠিক আগে ভোরের প্রথম দিকে এই অনিশ্চয়তা শুরু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাসের কিছু ‘হাল্কা উপসর্গ’ দেখা দেয়, কিন্তু বুধবার রাতে ৭৪-বছর বয়স্ক মি. ট্রাম্প জানান যে, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া কোয়ারেন্টাইনে গিয়েছেন। তারপর প্রেসিডেন্ট নিজেই টুইটারে করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা জানান। সেই সাথে তার স্ত্রীও। তারপর থেকে হোয়াইট হাউসের সহায়তাকারী এবং কর্মীরা বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝেও স্বাবাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তবে মেজাজ এমন ছিলো যে, তা ভূমিকম্পে আঘাত প্রাপ্তের মতো দেখা যাচ্ছিলো। উদ্বেগ, চিৎকার এবং কারো চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছিলো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকট নিয়ে আশাবাদী কথা বলে আসছিলেন যে, তিনি মহামারী মুক্ত করতে কাজ করতে পারবেন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ২ লক্ষাধিক মানুষ করোনায় মারা গেছেন। এর পরও তিনি বলেছেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
বৃহস্পতিবারও একটি দাতব্য অনুষ্ঠানের রেকর্ড করা ভাষণে তিনি দাবি করেছিলেন যে, মহামারী সমাপ্তি হতে বেশি দেরি নেই। গত মাসে ক্লেভল্যান্ডে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিতর্ক চলাকালীন সময় ডেমোক্র্যাটিক দলের জো বাইডেনকে তুচ্ছ করেও কথা বলেছেন। অনেক কটাক্ষ করেন ভাইরাস নিয়েও। জো বাইডেন বিভিন্ন স্থানে মাস্ক পরে যেতেন বলে তাচ্ছিল্য করেও কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। ভাইরাস বিষয়ে ট্রাম্পের এহেন নানা বক্তব্য আমেরিকানদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে।
তাছাড়া গত কয়েক মাস ধরে ভাইরাস সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য তার সহকর্মী ও হোয়াইট হাউসের কর্মীদের কথা ও কাজে প্রভাব ফেলে। তাদের চলাফেরা কোভিড যুগের আগের মতো ছিলো। তাদের অনেকেই মাস্ক এড়িয়ে চলতেন। বিভিন্ন অতিথিদের নিয়ে টেবিলে জড়ো হয়ে গল্প করতেন। অনেকে ইভেন্টও হয়। অনেক সময় বিশষজ্ঞ পরামর্শকদের পরামর্শও এড়িয়ে চলা হয়। মোটামুটি বলা যায়, মহামারীকে তারা অবজ্ঞা করেছেন।
এখন প্রেসিডেন্ট অসুস্থ এবং তার সহযোগিরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন ও লড়াই করছেন। পুরো অফিসে আক্রমণ করেছে ভাইরাস। প্রথমে প্রেসিডেন্টের শীর্ষ উপদেষ্টা হোপ হিকস পজিটিভ হন, সেই সাথে তার প্রচার সহযোগী বিল স্টিপিয়েন, দুই রিপাবলিকান সিনেটর এবং রিপাবলিকান জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান রওনা ম্যাকডানিয়েল। হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ কর্মীরা এখনে আইসোলেশনে গেছেন। জুনিয়র স্টাফরা যোগাযাগ ট্রেসিংয়ে ব্যস্ত। এক বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেও তারা সাহস রাখার চেষ্টা করছেন, যদিও অজানা উদ্বেগ ভার করেছে সবার চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ল্যারি কুডলো শুক্রবার সকালে আমাকে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন এতে অর্থনৈতিক ব্যাপারে অনেক ভালো খবর আসছে। এছাড়া তিনি আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই একমাত্র বিশ্ব নেতা নন যিনি কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, ব্রিটেন ও ব্রাজিলের শীর্ষ নেতারাও আক্রান্ত হয়েছেন। “ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দীর্ঘদিন আমার বন্ধু, তিনি খুব কঠিন সময় পার কছেন। আমি প্রার্থনা করি আমাদের প্রেসিডেন্ট যেন এমন কঠিন সময়ে না পড়েন’।
প্রেস সেক্রেটারি কালেহি ম্যাকেনি বলছিলেন যে, হোয়াইট হাউসে সবকিছু ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের যত্ন নিচ্ছিলেন। তার হালকা লক্ষণ রয়েছে। তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবেন’।
এদিকে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত এক জুনিয়র কর্মচারীকে কান্নায় ভেড়ে পড়তে দেখা গেলো। অন্য পাশে নিস্পৃহ অবস্থায় অনেকে বসে আছেন। কারো হাতে স্যানিটাইজারের বোতল, খবরের কাগজ বা একটি বেসবল হাতে অপেক্ষামান!
শুক্রবার হোয়াইট হাউস কাভার করা তিন সাংবাদিকের করোনা পজিটিভ এসেছে। এ তথ্য দিয়েছে সিএনএন। অন্যদেরও পরীক্ষা করা হয়। আমারও পরীক্ষা করা হয় সকালে।তবে আমি স্বাভাবিক রিপোর্ট পেয়েছি।
এরই মধ্যে হোয়াইট হাউসের একজন এসে আমাদেরকে কালো ভ্যানে উঠতে বললেন। আমরা উঠে পড়লাম। কালো জানালার ওই ভ্যানে করে আমরা হাসপাতালে পৌঁছলাম। জরুরি বিভাগের পাশে আমরা নেমে পড়ি। দেখলাম, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে চলেছেন হাসপাতালের ভেতরে। আমি এক ঝলক দেখলাম, মনে হয়েছে তিনি বশীভূত।
লিখেছেন-বিবিসির হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা