সান ডিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে: আর মাত্র ক’দিন পরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন ডোনাল্ড ট্রা¤প। সে-নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। ট্রাম্পের বিদেশনীতি কি হবে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন কোনো চমক আনবেন কিনা, অভিবাসী সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো হার্ড লাইনে যাবেন কিনা এমন হাজারতর প্রশ্ন ঝুলে রয়েছে। তবে এ সকল কিছুর সাথে সমালোচকরা কথা বলছেন একটি কালো এটাচি কেসের ভবিষ্যত নিয়েও। কি আছে ওই এটাচি কেসে এবং এটি নিয়ে তাঁদের এতো শঙ্কা কেন সে নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
অনেকেই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস ছেড়ে যখন অন্যত্র যান, তখন সর্বদাই একজন মেরিন সেনা তার অনুগামী হয় দু-হাতে দুটি এটাচি কেসসহ। না, গুরুত্বপূর্ণ কোনো দলিলাদি থাকে না তাতে, বরং থাকে আমেরিকার কর্তৃত্বে¡ থাকা প্রায় তিন হাজার পারমাণবিক বোমা সক্রিয় করবার চাবিকাঠি। এ-তে থাকে মূলত চারটি বস্তু একটি বই, যাতে পারমাণবিক আক্রমণের পন্থাসমুহ লিপিবদ্ধ থাকে; একটি কার্ড, যাতে আছে পারমাণবিক আক্রমণের নির্দেশ দেবার জন্যে গোপন কিছু কোড, আছে আপদকালীন সময়ে প্রেসিডেন্টের ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত কয়েকটি গোপন বাঙ্কারের ঠিকানা আর আছে দুর্যোগের সময়ে ব্যবহারের জন্যে একটি অতি সুরক্ষিত এবং গোপন ব্রডকাস্ট সিস্টেম। এই চারটে বস্তুর মাঝে ওই যে পারমাণবিক আক্রমণের কোড-সম্বলিত কার্ড, মূলত ওটি নিয়েই সকলের দুশ্চিন্তা। ব্যাপারটি আরেকটু ভাঙিয়ে বলি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে নীতি-নির্ধারকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার-সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে। এ এমন এক ভয়ানক অস্ত্র যেটি যুদ্ধবাজ, বিদ্রোহী কিংবা খ্যাপাটে কোনো সমরনেতার হাতে পড়লে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে। তাই সে-সময়েই ঠিক করা হল, সামরিক বাহিনীর হাতে শুধু থাকবে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করার দায়িত্ব, কিন্তু সেই নিক্ষেপের চূড়ান্ত নির্দেশটি আসতে হবে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। প্রেসিডেন্ট তার কাছে ওই এটাচি কেসে থাকা কার্ড থেকে গোপন কোডগুলো পড়ে নির্দেশ দিলে সামরিক বাহিনীর কেও বোমা নিক্ষেপের এন্তেজাম করবেন।
কিন্তু সমস্যা হল, আমেরিকা দেশটিতে প্রেসিডেন্টের সকল কর্মকাণ্ড একধরণের ‘চেক এন্ড বেলেন্সে’র’ হাতে বন্দি হলেও এই একটি ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট কারও কাছে জবাবদিহি ছাড়াই একক সিধান্তে বোমা ছোঁড়বার নির্দেশ দিতে পারেন, এক্ষেত্রে বাকিদের কাজ কেবল প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করা। আর ওই যে মেরিন সেনার সর্বত্র এটাচি কেস বহনের সংস্কৃতি, সেটি শুরু হয়েছিলো কেনেডির সময় থেকে। ষাটের দশকের সে-সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার নাকের ডগায় কিউবায় মিসাইল স্থাপন করেছে, এমতাবস্থায় কোনো আক্রমণের মুখে প্রেসিডেন্ট যাতে মাত্র পনের মিনিটের মাঝেই পারমাণবিক প্রতি-আক্রমণ চালাবার নির্দেশ দিতে পারেন, সে-জন্যে তখন থেকেই এই ব্যবস্থা।
তবে এ নিয়ে এতকাল কেও দুশ্চিন্তায় ভোগেননি। কিন্তু ট্রাম্পের বিজয়ের পর অনেকের কপালেই ভাঁজ পড়েছে। বিরোধী শিবির তো বটেই, এমনকি ট্রাম্পের নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির অনেকেও এ নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন। তাঁদের কথা হল, ট্রাম্প স্পষ্টতই একজন বদমেজাজি, স্ববিরোধী এবং কূটনৈতিক জ্ঞানবিহীন মানুষ। যিনি কিনা সামান্য সমালোচনায় ক্রুদ্ধ হয়ে টুইটারে গালমন্দের ঝড় তোলেন, তিনি কোনো আগ্রাসী দেশ কিংবা রাষ্ট্রনেতার কর্মকাণ্ডের জবাবে আলোচনার টেবিলে না গিয়ে সোজা বোমা চালাবার নির্দেশ দিয়ে বসেন কিনা কে জানে!
সাংবাদিকরা এ-নিয়ে বেশ কয়েকবারই ট্রাম্পের কাছ থেকে একটি যুতসই উত্তর খুঁজেছেন, কিন্তু জবাবে তিনি যা বলেছেন তাতে ধোঁয়াশা কাটেনি। এই যেমন, একবার তিনি বলেছেন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি তিনি বোঝেন, তাই তিনি আলোচনার পথ উন্মুক্ত রেখে সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে এটি ব্যবহার করলেও করতে পারেন। আবার এই তিনি-ই অন্য সময়ে বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে আমেরিকার সক্ষমতা তিনি আরও বৃদ্ধি করবেন, যেটি হয়তো বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও উসকে দিতে পারে।
তাই প্রকৃতপক্ষে তিনি কী করবেন সে ব্যাপারে এই মুহূর্তে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়তো একটু দুরূহ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)