২৬শে জুন, ২০০০ সাল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। ১৮ বছর আগের এই দিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। পড়ল ১৯-এ পা। দেড় যুগের পথচলায় কঠিন সময়ই গেছে বেশি। বারবার হোঁচট খেতে খেতে শেখা বাংলাদেশ দল এখনও তারুণ্যে থাকলেও যৌবনে পদার্পণের আভাস মিলেছে টাইগারদের সাদা পোশাকের পারফরম্যান্সে।
টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার বছরেই(নভেম্বর) প্রথম ম্যাচ খেলে ফেলে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অভিষেক টেস্টের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। দশ নম্বর দল হিসেবে শুরু করা লাল-সবুজরা চলতি বছরে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের আটে উঠেছে। এই অর্জনই স্বপ্ন দেখাচ্ছে সামনের সময়ে ধাপে ধাপে উন্নতির।
এপর্যন্ত বাংলাদেশ খেলেছে ১০৬টি টেস্ট। যার মধ্যে জয় ১০ ম্যাচে, ড্র ১৬, আর হার ৮০টিতে। প্রত্যাশিত পথে আগাতে না পারার পেছনে ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স ঘাটতির সঙ্গে কম টেস্ট খেলাও একটি কারণ। গড় করলে সময়টাতে বছরে টাইগাররা টেস্ট পেয়েছে ৬টি করে। সাদা পোশাকে মাঠে নামার ক্ষেত্রেও সমানুপাতিক হার মেলেনি। লম্বা বিরতি দিয়ে দিয়ে খেলতে হয়েছে অনেক সময়ই। যেটি কখনও গিয়ে ঢেকেছে বছরে। যে কারণে টেস্টে শেখা ও ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কেটেছে অনেক সময়!
আইসিসির নতুন ফিউচার ট্যুর কাঠামোতে অবশ্য কমে আসছে বিরতি। আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খেলবে ৪৫টি টেস্ট। বেশিরভাগ সিরিজই দেশের বাইরে। নিজেদের প্রমাণের যেমন সুযোগ তেমনি চ্যালেঞ্জও সামনে।
টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির প্রেক্ষাপট
১৯৯৬ সালে এসিসি ট্রফি জয়ের পরের বছরই আইসিসি ট্রফি জিতে নেয় বাংলাদেশ। নিশ্চিত হয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর শক্তিশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে বড় জয়। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে আইসিসি। পরের বছর ২৬ জুন ইংল্যান্ডের লর্ডসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সভায় সবকটি (৯টি) টেস্ট খেলুড়ে দেশের সমর্থন পেয়ে দশম দল হিসেবে অভিজাত ক্লাবে ঢোকার মর্যাদা পায় বাংলাদেশ।
সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটারদের প্রেসক্রিপশন
টেস্ট আঙিনায় আরও উন্নতির পথে হাঁটতে হলে কী করণীয়- সেটি সম্পর্কে চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে মতামত জানিয়েছেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, মোহাম্মদ আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফীস ও সাইফুল ইসলাম।
মিনহাজুল আবেদিন (প্রধান নির্বাচক): ১৮ বছরে আমাদের অর্জন অবশ্যই ভালো। আমরা র্যাঙ্কিংয়ের আটে এসেছি। তবে এই সংস্করণে বিদেশের মাটিতে আরও ভালো খেলতে হবে। যেহেতু সামনের বছর থেকে অনেকগুলো টেস্ট খেলার সুযোগ, আমাদের এগিয়ে চলার পথ শুরু হল। আশা করি টেস্ট ক্রিকেটে আমরা আরও প্রতিষ্ঠিত হবো। ওয়ানডের মতো টেস্টও আরও এগিয়ে যাবো। কিছু সিরিজ আমাদের উল্লেখ করার মতো ছিল। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে হোম সিরিজে ভালো খেলেছি। শ্রীলঙ্কার সাথে ওদের মাটিতে যথেষ্ট ভালো একটা সিরিজ খেলেছি। এগুলো থেকেই উন্নতির লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আগে যেখানে তিনদিনেই অলআউট হয়ে যেতাম বা সংগ্রাম করতে হত, সেই ব্যাপারটি এখানে দেখা যায়নি। টেস্ট মেজাজে কী করে খেলতে হয় সেটাও আমরা বুঝতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস আগামী প্রজন্ম এই ধারাবাহিকতায় আরও অনেকদূর যাবে।
মোহাম্মদ আশরাফুল (সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান): সামনে অনেক টেস্ট। যেটি আমাদের উন্নতির পথে সহায়ক হবে। শেষ ৪-৫ বছর টেস্টে খুব ভালো খেলছি আমরা, কিন্তু নিয়মিত ম্যাচ খেলছি না। ১৮ বছরে ১০৬ ম্যাচ খেলেছি, কিন্তু দেখা গেছে ১২ মাস, ১৪ মাস, ১১ মাস, ৯ মাস- এমন লম্বা বিরতিও পড়েছিল। খেলার মাঝে বিরতি পড়ায় নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। নয়তো আরও উন্নতি হত। সামনের পাঁচ বছরে উন্নতিটা বোঝা যাবে। বেশি বেশি ফোর ডে ম্যাচ খেলতে পারলে ভালো। টেস্ট ম্যাচের প্রস্তুতি যদি আমরা ফার্স্ট ক্লাসে পাই তাহলে ভালো। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এডি বারলো(সাবেক কোচ) অসুস্থ হয়ে গেল। কোচ হিসেবে তারপর ছিল ট্রেভর চ্যাপেল ও মহসিন কামাল। শুরুর সময়ে আমাদের ভালো একজন অভিভাবক দরকার ছিল। এজন্য টেস্টে উন্নতির গ্রাফ আমাদের কম। যদি ভালো কোচ পেতাম শুরুতেই, বারলো যদি সুস্থ থাকত, হয়ত ভিন্ন কিছু হতে পারত। শুরুর সময়টা ভালো হলে র্যাঙ্কিংয়ে হয়ত ৫-৬এ থাকতাম আমরা। শুরুতে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এখন দল কিছুটা থিতু। তারপরও আমার মনে হয় ট্রু-উইকেটে ২০ উইকেট নেয়ার মতো বোলিং ইউনিট নেই আমাদের। এই জায়গায় স্কিল বাড়াতে হবে। অনেকগুলো ব্যাটসম্যান বের হয়েছে কিন্তু বোলিংটা সেই মানের নেই।
শাহরিয়ার নাফীস (বর্তমান ক্রিকেটার): প্রথমত বলি, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া অনেক বড় অর্জন ছিল। দ্বিতীয়ত, আমরা ধীরে ধীরে সামনের দিকে যাচ্ছি। র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে যে প্রতিভা ও খেলোয়াড় আছে তাতে গত ১৮ বছরে যতটুকু এগিয়েছি সামনে আরও ভালো আগাতে পারবো। একজন খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বাস করি দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য লংগারভার্সন ক্রিকেটে উন্নতি করতে হবে। কারণ এখানে যারা ভালো তারা ওয়ানডেতে ভালো, টি-টুয়েন্টিতেও ভালো। যদি অবকাঠামো ও প্রক্রিয়া আরেকটু ভালো করতে পারি, দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাবো আমরা। আগামী ৫ বছরে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত যতটুকু এগিয়েছি এখান থেকে আরও ২-৩ ধাপ আগানো।
সাইফুল ইসলাম (সাবেক পেসার): সবার একটা স্বপ্ন থাকে টেস্ট খেলার। আমারও স্বপ্ন ছিল, কিন্তু খেলা হয়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য টেস্ট মর্যদা ছিল সিঁড়ি। টেস্ট দলকে আইসিসি মূল্যায়ন করে, প্রাধান্য দেয়। টেস্ট স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য ওই সময়টাই উপযুক্ত ছিল। আইসিসি সঠিক সময়েই আমাদের স্ট্যাটাস দিয়েছে। আমরা হয়ত এখনও ওই স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে পারিনি। ওই পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে আরও অনেক কিছুই লাগে। অবকাঠামো, খেলোয়াড় তৈরি করা। ক্রিকেটে এখন তিনটা ফরম্যাট হয়ে গেছে। তিন ফরম্যাটেই মানসম্পন্ন খেলোয়াড় তৈরি করা উচিত। তাহলেই আমরা আগাতে পারবো। ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারবো খেলোয়াড় তৈরি করার মাধ্যমে। অবকাঠামো তৈরি করতে হবে আর খেলোয়াড়দের সব ফরম্যাটে মানসম্পন্ন ক্রিকেট খেলার তাগিদ থাকতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেকদূর এগিয়ে যাবে।