বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, বিটিআরসি’র পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে আজ নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। যদি এ টাকা পরিশোধ করা না হয়, তাহলে প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা আদায়ের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে বলেও আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এই টাকা পরিশোধের সময় সম্পর্কে বিটিআরসি’র আইনজীবী বলেন- ‘দ্রুত এই টাকা দিতে গ্রামীণফোনকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিটিআরসির যে পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, এর মধ্যে তারা গ্রামীণফোন যদি দুই হাজার কোটি টাকা এখন না দেন, তাহলে হাইকোর্ট থেকে যে নিষেধাজ্ঞা নিয়েছিল সেটা ভ্যাকেট (প্রত্যাহার) হয়ে যাবে। এর অর্থ হলো এখন গ্রামীণফোনকে দুই হাজার কোটি টাকা দিতে হবে। তারা যদি না দেয় তাহলে বিটিআরসি যেকোনো অ্যাকশন নিতে আইনগত আর কোনো বাধা থাকবে না। আদেশের অনুলিপি পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। এখন কথা হচ্ছে, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে, যদি তারা দুই হাজার কোটি টাকা দেয় । এটা তো ফাইনাল সেটেলমেন্ট না। এখন দুই হাজার কোটি টাকা দিলে পরবর্তীতে যদি দেখা যায়, মামলায় বিটিআরসি আরও বেশি টাকা পায় তাহলে দেবে। সুতরাং আমরা আপাতত সন্তুষ্ট। এটা তো ফাইনাল না। আমরা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। এটা নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। হাইকোর্টেও আছে। ওই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরে জানা যাবে বিটিআরসি আর কত টাকা পাবে বা পাবে কি না।’
অন্যদিকে গ্রামীণফোনের আইনজীবী বলেন- ‘তিন মাসের মধ্যে টাকা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। দুই হাজার কোটি টাকা না দিলে তিন মাস পরে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। আমরা আদেশ পাওয়ার পরে ক্লায়েন্টে গ্রামীণফোন এর সাথে আলাপ করব, রিভিউ করব কি না দেখা হবে। তিন মাস সময় আছে। আর এক মাসের মধ্যে রিভিউ করার জন্য সুযোগ আছে।’
এর আগে গত ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আবদুল হাকিম ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির প্রায় ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা দাবি আদায়ের ওপর দুমাসের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দেন। পরে গ্রামীণফোনের কাছে ওই টাকা দাবি আদায়ের ওপর হাইকোর্টের দুমাসের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা স্থগিত চেয়ে বিটিআরসি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন। গত ১৪ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানিতে অর্থমন্ত্রী ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ২০০ কোটি টাকা পর্যায়ক্রমে বিটিআরসিকে দিতে সম্মতির কথা জানায় গ্রামীণফোন। তবে, এর বিরোধিতা করে বিটিআরসির আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ‘গ্রামীণফোনের কাছ থেকে বিটিআরসির পাওনা আদায়ের ওপর হাইকোর্টের দেয়া নিষেধাজ্ঞা আমরা স্থগিত চাই।’ এর আগে গত ৩ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে গ্রামীণফোনের এক সমঝোতা বৈঠকে পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবগুলো হলো-
১. দুই পক্ষ একটি কমিটি গঠন করে পাওনা পরীক্ষা অথবা পরীক্ষার পদ্ধতি বের করবে।
২. বিটিআরসি লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিশ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। অন্যদিকে অপারেটররা মামলা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেবে।
৩. অর্থমন্ত্রী, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, এনবিআর ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখবেন।
০৪. কমিটি গঠন ও কমিটির কাজ শুরুর আগে আগামী সাত দিনের মধ্যে গ্রামীণফোন ১০০ কোটি ও পরের এক মাসের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা বিটিআরসিকে দেবে। রবি দেবে দুই দফায় ৫০ কোটি।
০৫. এসব প্রস্তাব দুই অপারেটর তাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যালোচনা ও অনুমোদনের জন্যে উপস্থাপন করবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগে এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘গ্রামীণফোন এবং রবির কাছে টাকা পাওনার সমস্যা অন্য কোনো পথে নয় বরং সমাধান করা হবে আলোচনার মাধ্যমে। বকেয়ার বিষয়ে যে সমস্যা তা সমাধানে তারাও হারবে না, আমরাও হারব না। তারা এ দেশে ব্যবসা করবে এবং আমাদের পাওনাও বুঝিয়ে দেবে। এ ক্ষেত্রে আমরাও তাদের সাহায্য করবো। দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করে যাচ্ছে। এখন বকেয়া নিয়ে বিরোধ। তারা গ্রামীণফোন ও রবি কিছু কিছু ব্যাপারে বিরোধ করছে। আমরা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেছি।ভুল বোঝাবুঝির জন্য এ সমস্যা হয়েছে। আমরা দেখছি কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে সমস্যার সমাধান হবে। তবে আমাদের ক্ষতির সম্ভবনা বেশি। কিন্তু সমাধানের বাইরে আমরা অন্য কোনো পদ্ধতিতে যাব না। আমরা আশা করি দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে এটি সমাধান হবে। আমরা এ জন্য আদালতে যাব না, নিজেরা বসেই সিদ্ধান্ত নেব। আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করব।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার ও তখন বলেন- ‘বড় দুটি অপারেটরের সাথে দেনা পাওনার বিষয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। আমাদের সবার মত একই। আমরা চাই না ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হোক। আবার জাতীয় রাজস্বও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাচ্ছি তখন অর্থমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা কোনো পক্ষকে হারাতে চাই না, আবার নিজেরাও হারতে চাই না। ব্যবসার জন্য সুন্দর পরিবেশ থাকুক সেটা চাই। কারও সদিচ্ছার কোনো অভাবে নেই। আমরা পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারব।’
অর্থমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আদালতে না যাওয়ার কথা বললেও তারা এই বিরোধ মেটাতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে গিয়ে পৌছায় এবং সবশেষ আদালত আজ গ্রামীণফোনকে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। আরও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ত্রিপক্ষীয় এই দ্বন্দ্ব কোন পথে যায়- তা জানার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।