সাম্প্রতিক কালে কিশোর গ্যাং এবং টিকটক ও লাইকি অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই বছরের শুরুতে আমাদের বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় কিশোর গ্যাং এর অপরাধ ও তাদের বেপরোয়া চলাফেরা নিয়ে সিরিজ আকারে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গত বছর ও এই বছর আমাদের গণমাধ্যমগুলো জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে শতাধিক কিশোর গ্যাং অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত। কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও বহন, মাদক সেবন ও বিক্রি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। বেশিরভাগ কিশোর গ্যাং মাদক সেবন সহ স্থানীয় পর্যায়ে অন্যান্য অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত মর্মে তথ্য প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের বিগত কয়েক বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সের শিশু ও কিশোরগণ বিভিন্ন প্রকার অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রয়ের মত অপরাধগুলোতে প্রায় প্রতিদিনেই কিশোরেরা জড়িত থাকার প্রতিবেদন প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি কিছু কিছু ঘটনা খুবই লোমহর্ষক ও ভীতিকর।
গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশে টিকটক ও লাইকি অ্যাপের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সাধারণত কিশোর ও তরুণ বয়সের ছেলে মেয়ে এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে তাদের অনুভূতি ও বিভিন্ন কার্যক্রম ভিডিও এর মাধ্যমে অনলাইনে প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিককালে উক্ত অ্যাপগুলো ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেকে উক্ত অ্যাপগুলো ব্যবহার করে তারকা খ্যাতি অর্জন ও অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া টিকটক তারকা অপু (যিনি অপু ভাই নামে পরিচিত) তার কার্যক্রম ও ভিডিও নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছেন। তার ভিডিও দেখে বুঝা যায়, সেখানে ব্যাপক অশালীন শব্দের প্রয়োগ, অশ্লীল সংলাপ, বিকৃত শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে অপু টিকটক তারকা হিসাবে খ্যাতি পেয়ে যায়। তার কয়েক লক্ষ ফলোয়ার টিকটক ও লাইকিতে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে অপু কে টিকটক ও লাইকি হতে কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেন। অপু ও তার কিশোর গ্যাং বন্ধুরা রাস্তা বন্ধ করে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে তারা ব্যাপক মারধর করে ২ জনকে গুরুতর আহত করে।
গত কয়েক দিন সোশাল মিডিয়া ও ইউটিউব দেখে এবং বেশকিছু টিকটক ভিডিও ও লাইকি ভিডিও দেখি, যা রুচির অযোগ্য এবং ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বিকৃত অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্লীল শব্দ ও যৌনতা প্রয়োগ করে শুধুমাত্র সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই ভিডিওগুলো তৈরি করে আপলোড করা হয়। টিকটক ও লাইকি ভিডিও যারা নির্মাণ করেন, তাদের প্রায় ৮০% কিশোর কিশোরী বয়সের। তারা রাস্তা বন্ধ করে মোবাইলের মাধ্যমে ভিডিও ধারণ করতে যত্রতত্র দেখা যাচ্ছে। তাদের ভিডিওগুলো পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, এইরূপ বিকৃত ও অশ্লীল ভিডিওগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে দেখেছেন। ভিডিও নির্মাণ ও তার জনপ্রিয়তায় ইঙ্গিত করে, আমাদের সমাজের চরম অবক্ষয় হচ্ছে ও নেতিবাচক কাজ দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছ। অভিভাবকগণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের মননশীলভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করেন। জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ ও শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি শিশু। তাদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে বিচার ও তদন্ত শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী হবে। শিশু অভিযুক্তের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোতে বিচারাধীন আছে।
শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নির্দেশনা আছে। জেলা সমাজ সেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার শিশু অভিযুক্তকে নিয়ে আইনের আলোকে বিভিন্ন প্রকার দায়িত্ব রয়েছে। শিশু অভিযুক্তদের কাজ করার জন্য বেশকিছু সেইফ হোম ও কিশোর কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। শিশু অভিযুক্তরা মূলত জামিনের পূর্ব পর্যন্ত ও দণ্ড উক্ত উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে ভোগ করে। অভিযুক্তদের মানসিক উন্নয়নে কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। শিশুদের মানসিক উন্নয়ন, অপরাধ থেকে ফেরাতে সরকার কে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে শিশু ও কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা অনেক বেড়েছে। মোবাইলের সহজলভ্য ব্যবহার, ফেসবুক, টুইটার, টিকটকের আসক্তি ও অন্যদের সাথে পরিচয়, অপরিণত বয়সে সর্ম্পকে জড়ানো, রাজনৈতিক সংশ্লেষ ও মাদক সেবন কিশোর ও যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছে। চাকরীর সুবাধে বেশকিছু শিশু অভিযুক্ত কে দেখতে পাই, যারা মূলত ফেসবুক ও সমবয়সী বন্ধুদের মাধ্যমে এবং মাদক সেবনের ফলে অপরাধে জড়িত হন।
বর্তমান টিকটক জেনারেশন ও কিশোর গ্যাং এর অপরাধমূলক কার্যক্রম বিবেচনায় নিলে এটা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, শিশু কিশোরা বিভিন্ন প্রকার অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে এবং এই হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনি সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মধ্যে পড়বে। শিশু ও কিশোরদের লোমহর্ষক বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের হারও বৃদ্ধি পাবে। অভিভাবকদের সচেতনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ, সাইবার অপরাধ সর্ম্পকে ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো বেশি মননশীল উদ্যোগ ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই অবস্থা হতে উত্তরণ সম্ভব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)