টাঙ্গাইলে চারটি উপজেলায় বিদেশি দাতা সংস্থার নামে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের পাকা ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র তৈরি হয়েছে রহস্য।
ঘর প্রতি ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হলেও দেয়া হচ্ছে না কোন রশিদ ও বৈধ কাগজপত্র।
তবে সেই দাতা সংস্থা কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ বলছে, তাদের এ ধরণের কোন কার্যক্রম নেই। আর এর থেকেই তৈরি হয়েছে রহস্য।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও দাতা সংস্থা বলছে, একদিকে প্রতারণা অন্যদিকে গরীব ও অসহায় মানুষদের সহযোগিতার নামে জঙ্গিবাদ বিস্তারে কাজ করা হয়ে থাকতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার ভূঞাপুর উপজেলার ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম নাজিম উদ্দিন এবং তার শ্বশুর আব্দুর রউফ, কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গার শরিফ খান ও ঢাকার মাহবুবুল হক মিলে টাঙ্গাইলের চারটি উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক মানুষের কাছ থেকে পাকা ভবনের কথা বলে ভবন প্রতি সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা করে আদায় করেছে।
এরমধ্যে ওই উপজেলাগুলোয় প্রায় ২০টির মতো ভবনের কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে তারা ঘর নির্মাণের কাজ করছে। এছাড়া নাজিম উদ্দিনের শ্বশুর আব্দুর রউফ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় একই কায়দায় বিদেশী সংস্থার কথা বলে টাকা নিয়ে ঘর নির্মাণের কাজ করছে বলে জানা গেছে। তবে ঘর নির্মাণের জন্য নেয়া টাকার কোন রশিদ না দিলেও মালিকের জমির দলিল, ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নেয়া হচ্ছে।
কালিহাতী উপজেলার মালতি এলাকায় ঘর পাওয়া বানু বেগম, সাইফুল, সাদেকসহ আরো অনেকেই জানান, বিদেশী সংস্থা ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ১৮-২০ লাখ টাকার ঘর করে দিবে শুনে যোগযোগ করি। ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড মসজিদের ইমাম নাজিম উদ্দিন ও এলেঙ্গার শরিফ খানের কাছে অগ্রিম টাকা জমা দিলে তারা ঘর করে দিচ্ছে। কিন্তু কোন ধরনের কাগজপত্র তারা দেয় না। উল্টো আমাদের কাছ থেকে বাড়ির দলিলের ফটোকপি ও ভোটার আইডি কার্ড নেয়া হয়।
ঘর নির্মাণের কাজ পাওয়া ঠিকাদার আনিস জানায়, কেউ যদি ঘর নিতে চায় তাহলে তাকে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম নাজিমের কাছে পাঠিয়ে দেই। তারা সেখানেই টাকার লেনদেন করে। আমরা শুধু পাকা ভবন নির্মাণের কাজ করি। প্রতিদিন কাজ শেষে লেবারসহ অন্যান্য বিলের টাকা নাজিমের কাছ থেকে বুঝে নেই।
কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শুকুর মাহমুদ ও তার লোকজন মিলে এলাকায় বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ঘর দেয়ার কথা বলে টাকা তুলেছেন। এছাড়া চেয়ারম্যান নিজেই দুইটি ঘর নিয়ে তার আত্মীয়- স্বজনদের করে দিয়েছেন। শুধু তিনি একা নন সল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাদেক আলী মোল্লা, ভূঞাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবুসহ অনেকেই টাকার বিনিময়ে ঘর নিয়েছেন।
ঘর পাওয়া ভূঞাপুর উপজেলার কষ্টাপাড়া গ্রামের শামীম হোসেন জানান, ইমাম নাজিম ও তার শ্বশুর আব্দুর রউফের মাধ্যমে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে পাকা ভবন পেয়েছি। এ পর্যন্ত ভবনের ছাদ নির্মাণ হয়েছে। অন্যান্য কাজ এখনও বাকি রয়েছে।
ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেননি। তাছাড়া সংবাদ প্রচার করলে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন।
ঢাকার দারুস সালামের মেসার্স এসএম মাহবুবুল হকের সাথে কাজের বৈধতা, অর্থের উৎস বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবার কালক্ষেপন করেছেন। সর্বশেষ মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
বিদেশী সংস্থা কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মানব সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল হালিম মোবাইলে জানান, টাঙ্গাইলে টাকার বিনিময়ে ১৮২টি ঘর নির্মাণের বিষয়টি জানতে পেরেছি। তবে সেখানে (কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ) কোন কাজ চলমান নেই। তারা আমাদের নাম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছে।
তার দাবি, দেশের স্বাধীনতা ও মানবতা বিরোধী সংগঠনগুলোর একটি চক্র তাদের রূপ পরিবর্তন করে কৌশলে এসব কাজ করছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. নাজমুস সাদেকীন জানান, দেশের বাইরে থেকে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা এনবিআরের গাইড লাইন অনুযায়ী টাকা না আনা হয় তাহলে তা মানি লন্ডারিং আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এই টাকা সরকারের হিসেবের মধ্যেও পড়ছে না। টাকা যদি ভিন্ন উপায়ে দেশে আনা হয় সেটা ভিন্ন খাতে ব্যয় হতে পারে। সেই টাকা জঙ্গি অর্থায়নের কাজেও ব্যয় হতে পারে।
তিনি মনে করেন, সরকারের কাছে এই টাকার সঠিক হিসাব না থাকায় যে কোন ধরণের অপব্যবহার হতে পারে। অথচ এই টাকার বেনিফিট রুরাল অথবা ভালনারেবল পিপলের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেটাও তারা পাচ্ছেনা। যার ফলে মুদ্রাস্ফীতিসহ সার্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সাইন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. জহিরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জঙ্গী সংগঠনগুলো মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছেনা। তবে তারা তাদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। এক্ষেত্রে মনস্তাত্বিক সমর্থন আদায়ও তাদের একটি কৌশল। তাই শুধু ঘর করে দেয়া নয় বিভিন্ন সময় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপের মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে সেখান থেকে তারা ওই শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত করছে এবং তার পড়াশুনায় অর্থ ব্যয় করছে। এছাড়া গ্রাম পর্যায়ে গরীব অসহায় মানুষকে সহযোগিতার নামে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন হয়তো চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে তারা ঘর করে দিচ্ছে। কিন্তু তারা এর বাইরেও যারা বেকার ও অসহায় গরীব রয়েছে তাদের সহায়তা করছে। তাদের এই কাজগুলোকে যথাযথভাবে নজরদারী করা প্রয়োজন।
টাঙ্গাইলের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড অফিসার মোস্তাক আহমেদ বলেন, টাকা নিয়ে ঘর নির্মাণের কোন তথ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে নেই। এধরনের কোন তথ্যও নেই। তবে কেউ যদি অভিযোগ করেন তাহলে সেটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কালিহাতীর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) রাসেল মনির জানান, তাদের ঘর নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাসহ পুলিশের সদস্যরা কাজ করছে। এবিষয়ে যারা ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিভাবে তারা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেটার তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।