শেখের বেটা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র এ কারণেই (অন্য সহস্র কারণ বিবেচনায় না নিলেও) অনন্তকাল বাঙ্গালী তাকে স্মরণে রাখবে। আর দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কুখ্যাত সব রাজাকার আলবদরদের ফাঁসিতে লটকানোর জন্য ভবিষ্যত প্রজন্ম শ্রদ্ধাবনত ও কৃতজ্ঞ থাকবে শেখের বেটি’র প্রতি।
বলছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা শেখ হাসিনার কথা। সারাটা জীবন সংগ্রাম করে একজন আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আরেকজন বাংলার মাটিতে সেই স্বাধীনতার মূল সুরটি সংহত করে যাচ্ছেন।
স্মরণ করি, ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পরে তরুণ যুবা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশের রাজধানী ঢাকায় ফিরলেন। কলকাতা কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির জীবনে শেখ মুজিব মুসলিম লীগের হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। মূলত তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ভাব-শিষ্য। পাকিস্তানের সূচনা লগ্ন থেকেই ক্ষমতার কেন্দ্র, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলেই থাকলো। মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, এস্কেন্দার মির্জা, লিয়াকত আলী খাঁন প্রমুখরা পূর্ব পাকিস্তানের দেখভালের দায়িত্ব তাদের তাবেদার রাজনীতিক খাজা নাজিমউদ্দিন, মোনায়েম খাঁ, বগুড়ার মোহাম্মাদ আলী, নুরুল আমিনদের উপরেই ছেড়ে দিলো।
যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলো, গণবিচ্ছিন্ন ওইসব রাজনীতিকরা বছর না ঘুরতেই তা ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। পূর্ব পাকিস্তানে তখন মুসলিম লীগ সরকার এবং ওটাই একমাত্র রাজনৈতিক দল। পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। চারিদিকে শুধুই হাহাকার, সকল গণচাহিদা পদদলিত। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে কিছু একটা বললেই টুঁটি চিপে ধরা হয়, নেমে আসে জেল-জুলুম, নির্যাতন। কোনোক্রমেই যাতে মুসলিম লীগের বিপরীতে কোনো রাজনৈতিক শক্তি সংঘবদ্ধ হতে না পারে, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি ওদের।
এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, মোহাম্মাদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখরা গড়ে তুললেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫২ সাল থেকে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষু ও জেল-জুলুম উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
স্মরণ করি বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক ক্রান্তিকাল। প্রবল প্রতাপশালী জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। বন্দুকের নলের মাথায় ক্ষমতা দখলকারী জিয়ার দাপটে বাংলাদেশের বাঘ আর মহিষগুলো তখন একঘাটে জল খায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের প্রায় সকল সদস্যসহ হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে জাতীয় চার নেতাকে জেলের অভ্যন্তরে মেরে ফেলা হলো। পর্দার অন্তরালের দক্ষ খেলোয়ার জিয়াউর রহমান এসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেই দিনগুলোতে জিয়া কি করেনি?
মুক্তিযোদ্ধাদের নিপীড়ন-হত্যা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে স্বাধীনতার চেতনা মুছে দেওয়া, কুখ্যাত দেশবিরোধী গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে আনা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও রাজাকার আলবদরদের সুরক্ষা, মন্ত্রিত্বদান এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসন- আরো কত সব কীর্তি তার! তবে জিয়ার প্রথম লক্ষ ছিলো আওয়ামী লীগ, এ দলটি রাজনৈতিকভাবে যাতে কোনদিন শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে না পারে, এ উদ্দেশ্য পূরণে সে সব চেষ্টাই করেছে। জিয়ার শাসনামল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জন্য হত্যা-গুম, জেল-জুলুম আর নির্যাতনে পরিপূর্ণ ছিলো।
এমনই এক বৈরী পরিবেশে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সেই সময়টি এক বিভীষিকাময় কালো অধ্যায়। ‘আওয়ামী লীগ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘রাজাকার’, এ শব্দগুলো জিয়ার আমলে (অঘোষিত ভাবে) নিষিদ্ধ ছিলো। এ সব কথার উচ্চারণে তখন যে কোনো ব্যক্তিকেই রাজরোশে পড়তে হতো।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার এবং ক্ষমতা ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান তখন নিজের রাজনৈতিক দল ‘বিএনপি’ গড়ছে। সেই সময়ের বাস্তবতায় এমনটা ভাবা বেশ দুরূহ ছিলো যে, আওয়ামী লীগ কোনদিন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। দেশের মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে পারবে। দেশ ও জাতির সেই চরম দু:সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন। লক্ষ কোটি মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বরণ করে নিয়েছিলো। জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও মানুষের অধিকারের কথা ভেবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। তখন থেকেই শেখ হাসিনা মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে।
স্মরণ করি, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে) বিপুল বিজয় এবং সরকার গঠন। ১৯৫৮ সালে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হটিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি এবং এর বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অব্যাহত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মুজিবের বিরুদ্ধে মামলার পরে মামলা, এক মামলায় খালাস পেয়ে বের হতেই আরেক মামলায় মুজিব জেল গেটেই গ্রেফতার! স্মরণ করি ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে শেখ মুজিব কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের লক্ষে ছয় দফা দাবি উত্থাপন।
১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিব কারারুদ্ধ, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে মুজিবের কারামুক্তি এবং ছাত্র জনতা কর্তৃক তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করণ। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, ভয়াল ২৬ শে মার্চের সেই কালো রাত্রি! আরো স্মরণ করি, ন’মাস ব্যাপি আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ই ডিসেম্বরে লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়লো। কত বেদনা, কত অশ্রু, কত রক্ত, কত আনন্দ সেদিন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি, উপরোক্ত সকল ঘটনা প্রবাহের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পৃক্ততা ও তার একক নেতৃত্ব।
স্মরণ করি, ১৯৯০ এর স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে টানা ২১ বছর পরে তিনি তার সুনিপুণ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনলেন। বাংলাদেশে আবার ফিরে এলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পক্ষের সুবাতাস। চলার এই পথ তার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। ২০০৪ সালের ২১ শে আগষ্ট, তৎকালীন বিএনপি সরকারের নেপথ্য আয়োজনে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হলো। স্মরণ করি, শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও রায় কার্যকরে শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব।
সর্বশেষে স্মরণ করি, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অসামান্য সাহস, মনোবল ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জিয়া-এরশাদ-খালেদার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের রাজাকারেরা অতিশয় বলশালী হয়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ভিত, সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি, এমনকি মন্ত্রীর চেয়ারেও বসতে সক্ষম হয় তারা। কথিত এই রাজাকারদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগও অত্যন্ত প্রবল। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, পাকিস্তান প্রমুখ রাষ্ট্র এদের নেপথ্য সমর্থক।
এ বিচার প্রক্রিয়ায় আমরা লক্ষ করেছি জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত বিশ্ব সংস্থাগুলো কিভাবে এই রাজাকার-আলবদরদের পাশে দাঁড়িয়েছে! আর দেশের অভ্যন্তরে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতো বিচারের শুরু থেকেই মাজায় গামছা বেঁধে এদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
দেশি-বিদেশি এত সব বিপত্তি সত্তেও শেখের বেটি কিন্তু তার লক্ষে অবিচল, কর্মে সচল। শেখের বেটা যেমন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার জেল জুলুম উপেক্ষা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে অবিচল ছিলেন, ঠিক তেমনি আজ শেখের বেটিও সেই স্বাধীনতাকে সংহত করতে দেশি-বিদেশি রক্ত চক্ষু ও জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে দৃপ্ত পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছেন। বাংলার মানুষের প্রাণঢালা সমর্থনই বাপ-বেটির এই আকাশ ছোঁয়া সফলতার নেপথ্য চালিকা শক্তি। জয় শেখ মুজিব, জয়তু শেখ হাসিনা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)