চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে

‘বাবাকে যখন নিয়ে যায়, আমি খুবই ছোট ছিলাম। বাবাকে নিয়ে কোনো কিছুই আমার মনে পড়ে না। কিন্তু বাবাকে নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবার কাছ থেকে এতো কথা, অন্যদের এতো স্মৃতি শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সংস্পর্শে থাকা মানুষগুলোর সাথে আমি এতোটা সময় কাটিয়েছি এবং এখনো কাটাই যে, মনে হয় দৃশ্যগুলো আমি নিজে দেখেছি, সেগুলো আমার নিজের স্মৃতি। আমি চোখ বন্ধ করে সেগুলো মুখস্থ বলে যেতে পারি। আমার ভেতর থেকে কখনোই সেগুলো চলে যায় না।’

কালজয়ী সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে এভাবেই কথা শুরু করেন তাঁর মেয়ে শাওন মাহমুদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টের ভোরে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।

ছোটবেলায় বাবা সম্পর্কে পরিবারের কাছে জানতে চাইলেও তাকে খুব বেশি কিছু বলা হতো না। বাবা কোথায় জানতে চাইলে তাকে বলা হতো, তার বাবা দেশের মাটিতে মিশে আছেন। কবর কোথায় জানতে চাইলে জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখিয়ে দেওয়া হতো। বাবার ‘কবরের’ বিশালতায় তিনি অবাক হতেন।

বড় হওয়ার পর শাওন জানতে পারেন, বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তাঁর মৃতদেহ বা কবর পাওয়া যায়নি। শত চেষ্টা করেও আলতাফ মাহমুদের কোনো খোঁজ পায়নি তাঁর পরিবার।

অন্ততঃ বাবার কবরটি দেখার জন্য এক কন্যার ব্যাকুলতার কথা জানা যায় শাওনের মামা দিনু বিল্লাহর কথায়: ১৯৮৬ সালের ২৪ অক্টোবর আমার মা মারা যান। আমার মাকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে ‘রাঙা মা’ বলে অভিহিত করেন। সেদিন ঢাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছিলেন। বনানী গোরস্থানে মাকে দাফন সেরে মোনাজাত করে যখন সবাই বাড়ি ফিরছিলাম, তখন হঠাৎ ১৮ বছরের শাওন চিৎকার করে প্রথম ওর বাবার কথা বললো। চিৎকার করে আমার বড় ভাইকে শাওন বলেছিলো, ‘তোমার মার একটা কবর আছে, জায়গা আছে – আমার বাবার কবর কোথায়?’ শাহাদাত ভাই অনেকক্ষণ শাওনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবার স্নেহের এই শাওন। সবাই নির্বাক-নিস্তব্ধ! এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা ছিলো না। বনানী কবরস্থানে সদ্য দাফন করা মার কথা সবাই কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলো।

দিনু বিল্লাহ জানান: বাসার সবাই আমাকে মিষ্টি বলে ডাকে। এ নামটি শাওনের দেওয়া। এই মিষ্টি শাওনকে নিয়ে সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুল দিয়ে বলেছিলো– এটাই তোমার বাবার কবর, যেখানে লাখো শহীদ ঘুমিয়ে আছে। আরেকদিন শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো– প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি লাখো-কোটি বাঙালি তোমার বাবাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাবনত শিরে। বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষা যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন তোমার বাবা আর বাঙালির গর্বের শহীদ আলতাফ মাহমুদ বেঁচে থাকবেন। শাওন এখন বড় হয়েছে, ওর সংসার হয়েছে। ওর বাবার কোনো মৃত্যুদিন নেই, তাই বাবার ধরে নিয়ে যাওয়ার দিনটিকে শেষদিন মনে করে। ৩০ আগস্টকে শাওন ওর বাবার অন্তর্ধান বা হারিয়ে যাওয়ার দিন হিসেবে পালন করে।

একাত্তরে অবরুদ্ধ নগরী ঢাকায় সক্রিয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী ‘ক্র্যাক প্লাটুন’সহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন সুরে আর গানের সঙ্গে সবসময় রাজপথ আলো করা আলতাফ মাহমুদ। মজুদ করে রাখতেন অস্ত্র ও গোলাবারুদ। নিজেও অংশ নিয়েছেন একাধিক গেরিলা অপারেশনে।

একাত্তরের ৩০ আগস্ট লুকিয়ে রাখা দু’ ট্রাক অস্ত্রসহ আলতাফ মাহমুদকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। সাথে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর চার শ্যালক দিনু বিল্লাহ, লিনু বিল্লাহ, খায়রুল আলম বিল্লাহ ও নূহেল আলম বিল্লাহসহ মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারক আলভীকে।

তাঁদের কাছ থেকেই পরে শাওন জানতে পারেন, প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে বাসায় অস্ত্র লুকিয়ে রাখার দায়-দায়িত্ব আলতাফ মাহমুদ নিজের কাঁধে নেন। তাই নির্যাতনের পর ১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বাকি সবাইকে ছেড়ে দিলেও আলতাফ মাহমুদকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

‘আগে অনেক ব্যাপারই আমার কাছে গোপন রাখা হতো। যেমন অত্যাচারের ব্যাপারটা,’ বললেন শাওন। ‘বাবার সাথে পরিবারের অন্য যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, প্রত্যেকেই আমাকে বাবার ওপর চালানো অত্যাচারসহ বাবার অনেক স্মৃতি আমি বড় হওয়ার পরে বলেছেন; যা আগে বলতেন না। এখন আমি তার সবই জানি,’ বলতে বলতে বাবার সেই সময়ের কষ্টটা আরো একবার অনুভব করেন কন্যা শাওন মাহমুদ।

পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনে আলতাফ মাহমুদের পা ভেঙ্গে গিয়েছিলো, গায়ে ছিলো প্রচণ্ড জ্বর। অন্যদের ছেড়ে দেওয়ার সময় শ্যালক খায়রুল আলম বিল্লাহকে নিজের আংটি খুলে দিয়ে মেয়ে শাওনকে আংটিটা দিতে বলেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। অন্যরা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। এসবই শাওনকে বলা হয়েছে অনেক পরে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক

২০০৫ সাল থেকে আলতাফ মাহমুদ স্মরণে আগস্ট মাসের ৩০ তারিখ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক প্রদানের মাধ্যমে সম্মান জানান শাওন মাহমুদ এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন। এবার ১০ বছরে পড়ছে তাদের উদ্যোগ। উদ্যোগ এবং আয়োজনের ব্যাপারে শাওন বলেন, এর পেছনে বাবার জন্য সম্মান, বিশেষ আবেগ আর অনুভূতি তো আছেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি কাজ করে আরেকটি অনুভূতি, যা প্রত্যেক শহীদ সন্তানই হয়তো অনুভব করেন।একটা সময় পর্যন্ত তিনি মনে করতেন, বাবার জন্য কিংবা বাবার সম্মানে কেউ না কেউ কিছু করবেন। ‘এই চিন্তা নিয়েই আমি আমার বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি। কিন্তু আমার চিন্তাটা অবাস্তব ছিলো। পরে বুঝলাম, যা করার আমাকেই করতে হবে,’ বলে তাদের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটটা জানান তিনি।

শাওনের মনে হচ্ছিলো, তার বাবার নামে সরকার বা রাষ্ট্রের দিক থেকে যেনো আলাদাভাবে কিছু করার নেই। ‘সারা বাংলাদেশে বাবার নামে একটা ইটের টুকরাও নেই,’ বলতে বলতে বেদনায় অার্দ্র হন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির অমর সুরস্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ।

সেখান থেকে ভাবতে ভাবতেই ২০০৫ সালে খালু নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরামর্শে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা বা স্বীকৃতি প্রদানের পরিকল্পনা করা হয়। তখন অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মানুষ এগিয়ে আসেন। এভাবে প্রথমবারের মতো চিত্রগ্রাহক বেবি ইসলামকে সম্মাননা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। সম্মাননার অংশ হিসেবে দেওয়া হয় একটি ক্রেস্ট, ১০ হাজার টাকা এবং উত্তরীয়।

সময়ের সঙ্গে পদকের জন্য প্রথমদিককার অনুদানকারীর সংখ্যা কমে গেলেও পরিবারের দিক থেকে সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারণ এই একটি অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে আগস্ট মাসে তাদের মনে জমে থাকা সব শোক আর কষ্ট গৌরবের-বীরত্বের-অার-ত্যাগের আনন্দ হয়ে বেরিয়ে আসে।

অনুষ্ঠানটির জন্য মিলনায়তনের ভাড়া নেয় না মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ক্রেস্ট, কার্ড আর উত্তরীয়’র নামমাত্র খরচ নেন প্রস্তুতকারীরা। প্রথমদিকে প্রতিবছর একজন করে গুণী ব্যক্তিকে পদকটি দেওয়া হতো। পরে পারিবারিক সহযোগিতায় দু’জনকে পদক দেওয়া শুরু হয়। এ বছর শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পাচ্ছেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী।

সামর্থ্য বাড়লে আরো বেশি মানুষকে সম্মাননা জানানোর পরিকল্পনা আছে। এখন পর্যন্ত শুধু প্রবীণদের এই পদক দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে তরুণ শিল্পীদেরকেও সম্মানিত করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন শাওন মাহমুদ।