চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জুলহাস মান্নান: এক বন্ধুকে স্মরণ করে

নিঃস্বার্থ, সবাইকে ভালোবাসেন, সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকেন- জুলহাস মান্নানকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে তার বন্ধুরা এই শব্দগুলোই ব্যবহার করে থাকে। জুলহাস- যিনি ছিলেন একজন নিবেদিত সহকর্মী, অনুগত বন্ধু এবং মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রপথিক, ২০১৬ সালের এপ্রিলে নিষ্ঠুরভাবে খুন হন তিনি। তিনি শুধু আমার সহকর্মীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার বন্ধু এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস পরিবারের অংশ। আমরা যারা ভাগ্যবান তাকে জানতে পেরে, আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমাদের সকলের ওপর তার অসাধারণ প্রভাব নিয়ে আমি সবার সাথে আমার কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই।

নিঃস্বার্থ
জুলহাস নিঃস্বার্থভাবে জীবনযাপন এবং সমাজকে আরো বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভূক্তিমূলক করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করতেন। নিজের চেয়ে তিনি সব সময় অন্যকে এগিয়ে রাখতেন, সেটা কর্মক্ষেত্রেই হোক, আর বন্ধুদের সাথেই হোক অথবা কোন অচেনা কেউ, এমনকি নিজের বাড়ির একান্তে থাকা অবস্থায় হোক। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড)-র সহকর্মীরা তাকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখতেন। কিভাবে জুলহাস কোনরকম আর্থিক লাভ, স্বীকৃতি কিংবা পুরস্কারের প্রত্যাশা না করে দু’বছর ধরে একটি কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন একথা ভেবে আজও জুলহাসের সহকর্মীরা আনন্দিত হন। মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলাকে তিনি যে মূল্য দিয়েছিলেন তার মূল্য অর্থের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ছিল তার কাছে। প্রকৃতপক্ষে, তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে অর্থ বিলিয়ে দিতেন। মন-মানসিকতায় উদার জুলহাস সত্যিকারের বাংলাদেশী আতিথেয়তা এবং স্বার্থহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জুলহাস যখন মারা যান, সারা বিশ্ব থেকে তার জন্য এসেছিল ভালোবাসার শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাকে নিয়ে সে সময় যে আলোচনা হয় তাতে একটি বিষয় ফুটে ওঠে আর তা হলো- সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন যারা বাংলাদেশে আসতো তাদেরকে তিনি স্বাগত জানাতেন এবং সময় নিয়ে তাদেরকে এই দেশের চমৎকার দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যাদের জীবনকে তিনি তার ভালোবাসা দিয়ে স্পর্শ করেছেন আমরা তাদের কাছ থেকে এই সব গল্প শুনতেই থাকি।

প্রীতিপূর্ণ
জুলহাসের হৃদয় ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ। সবার প্রতি তার ব্যবহারে ছিল সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসা ভরা এবং যেকোন কাজই তিনি করতেন অত্যন্ত আগ্রহের সাথে। তিনি যে কেবল বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদেরই ভালোবাসতেন তাই নয়, তিনি শিল্পকর্ম, ফুল এবং গাছপালা এতোটা ভালোবাসতেন যে তিনি তার বাড়ির বেইজমেন্টে একটি কলাগাছ লাগিয়েছিলেন! তার চারপাশে যারা থাকতো এমনকি তাদের সাথে কোন কথা না বলেই জুলহাস তাদেরকে ভালোলাগার অনুভুতি এনে দিতেন। তার কাজ, বন্ধুতা ও অনিঃশেষ হাসি এক ধরনের ভালোলাগা ও ইতিবাচক অনুভুতি এনে দিত তার চারপাশে যা কেবল ভাষা দিয়ে প্রকাশ সম্ভব নয়।

জুলহাস জীবনকে ভালোবাসতেন, যেমনটি ভালোবাসতেন তার চারপাশের মানুষদেরকে এবং তার দেশকে।

অনুপ্রেরণীয়
যারা তাকে চিনতো না তাদের হুমকি ও কটূক্তি সত্ত্বেও জুলহাস নিজের প্রিয় দেশকে কিংবা যে সমাজের উন্নয়নের জন্য লড়াই করেছেন তাকে ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ছিল তার স্বদেশভূমি। জুলহাসের বন্ধুরা বলেছেন, যে পরিবর্তনের তিনি স্বপ্ন দেখতেন গত বছরের বসন্তে তা করার জন্য অনুপ্রাণিত ও বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার সেই সাহস বেঁচে থাকবে। তিনি আজ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করতে, সেখানে যতো বাধাই আসুক না কেন বা তার পরিণাম যাই হোক না কেন।

পরিবার
জুলহাস একটি পরিবার। তিনি তার মায়ের প্রতি নিবেদিত ছিলেন, তার ভাইবোনদের ভালো ও বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন এবং তাদের সন্তানদের ভালোবাসতেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাসে তার অন্য একটি পরিবার হিসেবে আমরা তার প্রচেষ্টাকে- আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে- এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার পূনর্ব্যক্ত করছি। সেই প্রচেষ্টা হলো মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যেন তার প্রতিভা বিকাশে সমান সুযোগ পায়। এটি আমার লক্ষ্য এবং আমি যাদের ভালোবাসি- সেইসব বন্ধু, সহকর্মী, দেশবাসী ও আমার পরিবার- তাদের জন্য আমি প্রতিদিন লড়াই করি, লড়াই করে বেঁচে থাকি।

*জুলহাস মান্নান যুক্তরাষ্ট্র ঢাকা দূতাবাসে প্রায় এক দশক ধরে কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। হত্যাকারীরা ঘৃণার আদর্শ দ্বারা পথভ্রষ্ট ছিলেন, যে আদর্শ ইসলাম ও বাংলাদেশে অপরিচিত।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)