দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দেখতে দেখতে কারাগারে একমাস পূর্ণ হলো বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা পাওয়ার পর থেকে তিনি পুরনো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের ২’ শ বছরের পুরনো কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।
কারাগারে যাবার পরে খালেদা জিয়া পরের সপ্তাহে জামিন লাভ করবেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা এমন আশায় বুক বেধে ছিলেন। কিন্তু নেতাকর্মীদের অপেক্ষা বাড়িয়ে খালেদা জিয়ার জামিনের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। আইনি প্রক্রিয়া ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির অপেক্ষা করছেন তারা।
৮ ফেব্রুয়ারি হাজারো নেতাকর্মীর বহর নিয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। আদালতে পৌঁছার ২০ মিনিটের মধ্যে তিনি পেয়ে যান রায়। বিচারক ঘোষণা করেন ৫ বছরের সাজা। রায়ের ২০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। বকশিবাজার আদালতের সঙ্গে লাগোয়া কারাগার। রাস্তার এপার আর ওপার। তাই খালেদা জিয়াকে কারাগারে ঢোকাতে কোন বেগ পেতে হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
আজ ৮ মার্চ। ঠিক এক মাস পূর্ণ হলো খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর। এই সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র স্বজনেরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বার কয়েক দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। এর বাইরে দু’বার সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন আইনজীবীরা। তবে প্রতিদিনই বিএনপি বা খালেদা জিয়ার অনুসারীদের মধ্যে কেউ না কেউ কারাগারে দেখা করতে আসছেন। কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় তারা ফিরে যাচ্ছেন।
‘আদালতে যেভাবে সময় কাটে খালেদা জিয়ারঃ
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র বন্দী। এই বন্দী জীবন কীভাবে কাটছে, তা নিয়ে দেশবাসীর কৌতুহলের শেষ নেই। কারাসূত্রে জানা যায়, বেশিরভাগ সময় ইবাদত বন্দেগী আর বই-খবরের কাগজ পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটে খালেদা জিয়ার। প্রতিদিনই তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। ফজরের নামাজ শেষে কিছুটা সময় তিনি কোরআন তেলোয়াতসহ ইবাদত বন্দেগী করেন। এরপর সকালের নাস্তা করেন। এরই মাঝে তার হাতে পৌঁছে যায় কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা। তিনি সেগুলো পড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এসব কাজ করতে তাকে সহায়তা করেন তার গৃহকর্মী ফাতেমা।
আত্মীয়স্বজনের সাক্ষাত:
প্রতিদিনই বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাতে এসে ফিরে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকেরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে না পেরে ফিরে যান। আত্মীয়–স্বজনের বাইরে এখন পর্যন্ত কাউকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিচ্ছে না কারা কর্তৃপক্ষ।
৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা কারার সুযোগ পান তার স্বজনেরা। ওইদিন তার মেজ বোন সেলিনা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার,তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা ও তাদের ছেলে ফায়েক ইস্কান্দার দেখা করেন। এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আবদুর রেজ্জাক খান,এজে মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিস্টার খন্দকার মাহবুব হোসেন। পরে তারা কারাফটকে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আইনি ও দলীয় বিষয়ে আলোচনা করেছেন তারা। আদালতের নির্দেশ ১১ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ডিভিশন দেয়া হয়। ওদিনই তার সঙ্গে গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগমকেও রাখার নির্দেশনা দেন আদালত। ১৩ ফেব্রুয়ারি ওকালতনামাসহ কিছু কাগজপত্রে খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর আনতে কারাগারে যান তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়াসহ কয়েকজন। কিন্তু, তারা দেখা করতে পারেননি। ফলে কাগজপত্রগুলো কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে ফিরে আসেন তারা। ১৪ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার অনুমতি চাইতে কারাফটকে যান বিএনপিপন্থী সাত চিকিৎসক। কিন্তু তারাও অনুমতি না পেয়ে ফিরে আসেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন তার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর শাশুড়ি মোখলেমা রেজা, খালেদার ভাইয়ের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, ভাগিনা সাজিদ ইসলাম, শাহরিয়ার আখতার ও ভাতিজা মো. আল মামুন।
রায়ের সত্যায়িত কপিঃ
রায়ের সত্যায়িত কপি না পাওয়ায় খলেদা জিয়ার জামিন আবেদন বিলম্বিত হয়। এ নিয়ে সরকারি মহল আর বিএনপি নেতাদের মধ্যকার বাকবিতণ্ডা গণমাধ্যমে বেশ প্রচারিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে রায়ের সত্যায়িত কপি হাতে পান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। বিচারক রায়ের কপি সত্যায়ন করার পর এটি খালেদার আইনজীবীদের হাতে তুলে দেন বিশেষ জজ আদালত–৫ এর পেশকার মোকাররম হোসেন। পরের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়াকে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিতে দ্বিতীয় দফায় সুপ্রিম কোর্ট বারের কনফারেন্স রুমে বৈঠক করেন আইনজীবীরা পরে আপিল ফাইল করেন।
আপিলের শুনানিঃ
২২ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল গ্রহণের বিষয়ে শুনানি হয়। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আপিল গ্রহণ করে বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়াকে করা অর্থদণ্ড স্থগিতের আদেশ দেন। একই সঙ্গে এ মামলায় বিচারিক আদালতের সকল নথি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট আদালতকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর জামিন আবেদন শুনানির জন্য নতুন দিন ঠিক করে দেন আদালত।
২১ ফেব্রুয়ারি যেভাবে কাটে খালেদা জিয়ারঃ
শহীদ মিনারের ঠিক সন্নিকটেই আছেন খালেদা জিয়া। এতো কাছে থেকেও মহান ভাষার মাসের ২১ শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেননি তিনি। নিজেদের প্রধান কারাগারে থাকায় এবছর বিএনপিও প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে যায়নি। পরদিন সকালে তারা শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান।
২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসের দিন খালেদা জিয়া অবশ্য পরিবারের সঙ্গ পান। এদিন তার সঙ্গে তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, ভাগ্নি অনন্যা ইস্কাদার, রাইজা ইসলাম, নাতনি শাহিনা জামান ও ভাগ্নে মো. মামুন দেখা করেন।
কারাফটকে ফল, মাছ-মাংসের রাজনীতি
খালেদা জিয়ার মতো একজন রাজনৈতিক নেতা কারাবরণ করলে তাকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা চিন্তিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে কারাগারে বাইরে থেকে ইচ্ছামতন খাবার দেবার সুযোগ না থাকলেও নেতাকর্মীরা তার জন্য ফল-মাছ-মাস নিয়ে হাজির হচ্ছেন। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এসব দেখে অনেকে একে ‘ফল-মাছ-মাংসের রাজনীতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। জেলে যাওয়ার একদিন পর থেকেই বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার জন্য ফল-ফলাদি, মাছ, মাংস নিয়ে কারা ফটকে ভীড় জমায়। সেগুলো পাঠানোর অনুমতি চান, কিন্তু পান না।
নিষ্প্রাণ আন্দোলন বিএনপিরঃ
খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপির আন্দোলনে প্রাণ নেই বললেই চলে। নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের বাইরে টুকটাক মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, লিফলেট বিতরণেই সীমাবদ্ধ আন্দোলন। অবশ্যই বিএনপি বলছে, দলীয় প্রধান নেতাকর্মীদের ধৈর্য্য ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেছেন। অনেক নেতাকর্মীদের প্রশ্ন, তবে এই ধৈর্য্যের বাধ কখন ভাঙবে কখন মুক্তি পাবে খালেদা জিয়া?
‘জামিনের অপেক্ষা শেষ হয় না’
খালেদা জিয়ার জামিন তার নেতাকর্মীদের নিকট ছোটগল্পে পরিণত হয়েছে। শেষ হয়েও হলো না শেষ। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ধরেই নিয়েছিলো শিগগিরই জামিন হয়ে যাবে খালেদা জিয়ার। খালেদা জিয়ার করা জামিন আবেদনের ওপর ২৫ ফেব্রুয়ারি শুনানিও হয়। কিন্ত বিলম্বিত হয় জামিন। নিম্ন আদালতের নথি আসার পরে এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হবে বলে জানান হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের বেঁধে দেয়া ১৫ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালত থেকে নথি পাঠানোর নির্দেশ থাকলেও ১৫ দিন প্রায় শেষের পথে, কিন্তু এখনো তা পৌঁছেনি। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের দূরত্ব মাত্র ৩ মাইল। এই ৩ মাইল পথ অতিক্রম করে ১৫ দিন লেগে যাচ্ছে। এটি কেমন ডিজিটাল দেশ? অবশ্যই খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লা মিয়া বলছেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি, নিম্ন আদালত নথি পাঠাতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তারা এখন সরকারি সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
অবশেষে জ্যেষ্ঠ নেতারাদের সাক্ষাতের সুযোগঃ
গত বুধবার (৭ মার্চ) বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা সাক্ষাতের সুযোগ পায় নিজেদের দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পান। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করার অনুমতি পেয়ে কারাগারে যান বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। বিকেল ৩টায় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে নিজেদের সর্বোচ্চ দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন,ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জে. মাহবুবুর রহমান(অবসরপ্রাপ্ত), ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস।
কারো উস্কানিতে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানঃ
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা গতকাল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে তার খবরাখবর বলেন এবং বক্তব্য তোলে ধরেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, কারাগারে খালেদা জিয়ার মনোবল অটুট ও দৃঢ় আছে। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, বর্তমান সরকার তাকে হেয় করতে মিথ্যা মামলায় এই সাজা দিয়েছে। তিনি কখনোই জেনেশুনে কোনো অন্যায় করেননি। তাকে দেশের জনগণ থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করা যায়নি, ভবিষ্যতেও করা যাবে না। তাকে অতীতেও নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু দেশ ও জনগণকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। এবারো তিনি করো সাথে আপোষ করবেন না। কারো উস্কানিতে পা না দিয়ে নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।