আরো একবার বলতেই হচ্ছে, সরকারি তোষণ আর সুযোগ-সুবিধায় এখন ঘুমিয়ে থাকা হেফাজতে ইসলাম আসলে অানসারুল্লাহ বাংলা টিমের সহোদর না হলেও কমপক্ষে খালাত ভাই। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে সম্প্রতি কথিত খোলা চিঠিতে যেসব হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে হেফাজতের দাবি-দাওয়া তুলনা করলেই বোঝা যায়, একই ঔরসে জন্ম না হলেও একই রক্তের উত্তরাধিকার তারা।
২০১১ সালে জন্ম হলেও সারাদেশের মানুষ হেফাজতের নাম শুনতে পারে শাহবাগের ঐতিহাসিক গণজাগরণের পর। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে ব্লগারদের মাধ্যমেই যেহেতু শাহবাগ আন্দোলন, তাই ‘ব্লগার মানেই নাস্তিক’ এমন মিথ্যা দাবি তুলে তারা শুধু ওই আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাঠেই নামে না, ঢাকাসহ সারাদেশে তুলকালাম কাণ্ডও ঘটায়। শাহবাগ আন্দোলনে ব্যক্তিগত চিন্তায় দুয়েকজন নাস্তিক থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু শাহবাগ মানেই নাস্তিক এমন দাবি করে দেশজুড়ে হেফাজতের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যই ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বন্ধ করতে না পারলেও অন্তত: বাধা সৃষ্টি করা।
তারই অংশ হিসেবে হেফাজত তখন ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে, যার দুই এবং তিন নম্বরে ছিলো: শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসুল (সা.) এর নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা, এবং • ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কেউই নাস্তিক না হলেও, ব্লগাররা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের তুলনায় শুধু ভগ্নাংশ হলেও, শাহবাগ থেকে ধর্মবিরোধী কিছু না বলে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হলেও; হেফাজত তখন শাহবাগ মানেই ব্লগার আর ব্লগার মানেই নাস্তিক এরকম মিথ্যা দাবি তুলে শাহবাগকেই তাদের সহিংস কর্মসূচির সব টার্গেটে পরিণত করেছিলো।
পরে তারা শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের নামে খালেদা জিয়ার তবারক, এরশাদের পানি আর ফরহাদ মজহারদের উস্কানিতে মাদ্রাসার শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারকে ফেলে দেওয়ার মিশনে ব্যর্থ হয়ে হাজার-হাজার মুসল্লি নিহত হওয়ার মিথ্যা দাবি তুলে পানি আরো ঘোলা করার চেষ্টায়ও ব্যর্থ হয়। তবে এর মধ্যে ‘ক্যাশ এন্ড কাইন্ড’-এ সুবিধা কম না আসলেও শাহবাগ এবং ব্লগারদের প্রশ্নে আগের অবস্থানেই আছে হেফাজত।
লক্ষণীয় যে শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের হেফাজত ‘স্বঘোষিত নাস্তিক’, ‘রাসুল (সা.) এর নামে কুৎসা রটনাকারী’ এবং ‘ইসলামবিদ্বেষী’ হিসেবে ভুয়া দাবি তুলেছিলো। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমও এখন শাহবাগকে নিয়ে একই ভাষায় কথা বলছে। এখন পর্যন্ত পাঁচজন ব্লগারকে হত্যা এবং অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর সর্বশেষ খোলা চিঠিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ব্লগারদের সম্পর্কে আরো মিথ্যা দাবি তুলে বলছে যে, তারা ‘দেশের অভ্যন্তরে গা ঢাকা দিয়ে সুকৌশলে এবং পরিকল্পিতভাবে ইসলামবিরোধী প্রচারণা, আলেম-ওলামাদের নামে মিথ্যাচার, ইসলামের সূতিকাগার পবিত্র আরব ভূমি নিয়ে একের পর এক বিষোদগার, মিথ্যাচার, অপপ্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে’।
তবে, হেফাজতের সঙ্গে আনসারুল্লাহর পার্থক্য হচ্ছে যে, হেফাজত নেতারা বক্তৃতায় শাহবাগের গণজাগরণের সংগঠক এবং ব্লগারদের ‘কল্লা’ ফেলে দিতে চাইলেও অন্ততঃ লিখিত ১৩ দফায় শাস্তির দাবি জানিয়েছিলো, আর আনসারুল্লাহ তথাকথিত লিখিত বিবৃতিতেও সরাসরি তাদের ‘কতল’ করার কথা বলছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তাদের তথাকথিত কোনো হিট লিস্ট নেই, কিন্তু প্রয়োজনে ‘রাব্বুল আলামিন তাদেরকে আজরাইল হিসেবে প্রেরণ করবেন’।
ব্লগারদের হুমকি দিয়ে আনসারুল্লাহ স্পষ্টভাবেই বলেছে: ‘সুযোগ পাওয়া মাত্র ইসলামের বীর সেনানীরা তাদেরকে কতল করবে। এই মর্মে হুঁশিয়ারি প্রদান করা যাচ্ছে যে, দেশ কিংবা বিদেশে পালিয়ে থাকা নাস্তিকদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কেউ যেন নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে না পড়েন। নইলে পরিণতি হবে নিলয় নীল কিংবা ওয়াশিকুর বাবু, অভিজিৎ রায়ের মতো। একটি নাস্তিককেও বেঁচে থাকতে দেয়া হবে না। এদের হত্যা করা রাসুলের (সা.) বিধান মতে ওয়াজিব।’
নারী প্রশ্নেও অভিন্ন অবস্থান
অনেকেরই মনে থাকার কথা যে, হেফাজত প্রধান আহমেদ শফি শুধু তেঁতুল তত্ত্বই দেননি, হেফাজত তার ১৩ দফায় নারীদের স্বাধীন চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞাও চেয়েছিলো। দাবিটি তারা এভাবে জানিয়েছিলো: ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।’
এরকম দাবির অংশ হিসেবেই আহমেদ শফির অনুসারীরা সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে শারীরিকভাবে হেনস্তাও করেছিলো যে কারণে মেয়েটিকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
হেফাজত তখন ১৩ দফায় নারীকে ঘরে বন্দী করার দাবি জানানোর পাশাপাশি নাদিয়া শারমিনের মতো সংবাদকর্মীকে মারধর করে যে আওয়াজ দিতে চেয়েছিলো সেটাই এখন আবার দিচ্ছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
গণমাধ্যমে পাঠানো তাদের সর্বশেষ খোলা চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘যেহেতু নারীদের ঘরের বাইরে চাকুরি করা, বেপর্দা হয়ে ঘোরাঘুরি করা ইসলামি শরীয়াহ মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাই যারা এদের চাকুরি দিচ্ছেন, করাচ্ছেন, তারাও সমানভাবে দোষী।’
এই ব্যাখ্যার পাশাপাশি সকল গণমাধ্যমকে নারীদের চাকুরি থেকে অব্যাহতিও দিতে বলেছে আনসারুল্লাহ।
মূল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা
বছর আড়াই আগে ১৩ দফা দাবি তুলে ঢাকা দখল করে হেফাজত সরকার উচ্ছেদের মাধ্যমে আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চেয়েছিলো। তাদের হঠাৎ উত্থানের নেপথ্যে আসলে ছিলো জামায়াত যার নেতাদের তখন হত্যা-গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে রায় দেওয়া শুরু হয়েছিলো। এই বিচার বন্ধ করতেই হেফাজতকে তখন মাঠে নামানো হয়েছিলো।
আর ব্লগারদের রক্তে রঞ্জিত যে আনসারুল্লাহর হাত, এখন তাদেরকেও জোরেশোরে একই উদ্দেশ্যে নামানো হচ্ছে। সেই উদ্দেশ্য সফল না হলেও অন্ততঃ এক ধরণের প্রতিশোধ নিতে চায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। এ কারণেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ যখন ঠিক কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায়, তখন ব্লগারদের নামে শাহবাগের গণজাগরণের সংগঠকদের সরাসরি ‘কতল’ করার হুমকি।
আবার গণমাধ্যমকে পাঠানো খোলা চিঠিতে আনসারুল্লাহ শুধু যে ব্লগারদের মেরে ফেলার কথা বলছে এমন নয়, সরাসরি রাষ্ট্র এবং সরকারকেও তারা এই বলে হুমকি দিয়েছে যে, তাদের লাখো সেনা প্রস্তুত হচ্ছে, যে কোনোদিন তারা খেলাফত কায়েমের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আল-কায়েদা কিংবা আইএসের জ্ঞাতিভাই হিসেবে আনসারুল্লাহ বাংলাদেশে খেলাফতের যে স্বপ্ন দেখে তার আপাতঃ লক্ষ্য আসলে মুজাহিদ-সাকা-নিজামীদের মৃত্যুদণ্ড ঠেকিয়ে দেওয়া। জামায়াতের পক্ষে হেফাজত একবার এই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আনসারুল্লাহর নামে মাঠে আছে জামায়াতের আরেক উইং।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)