সারা দুনিয়ায় ঘৃণা থেকে জন্ম নেওয়া অপরাধ বা হেইট ক্রাইম কি বেড়ে যাচ্ছে? যারা নিজেদের উন্নত জাতি হিসেবে দাবি করেন সেই সব দেশেও চলছে এই অপরাধ। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম সবার কাছেই জেরুজালেম ছিল পবিত্রস্থান। তাই তারা সবাই জেরুজালেমের দখল নিতে চাইতেন। তার আর একটি কারণ হচ্ছে জেরুজালেম আশেপাশের এলাকা ব্যবসা বাণিজ্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত ছিল ইউরোপের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই, শুধু যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া। কামানের মতো তখনকার দিনের ভয়াবহ অস্ত্র ছিল ইউরোপিয়ানদের হাতে। জেরুজালেম দখলের নামে (আসলে টাকা, পয়সা, ধন দৌলতের আশায়) ক্রুসেড শুরু হয়। যুদ্ধের সময় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে উন্নত ভবিষ্যতের লোভ দেখিয়ে যোদ্ধা সংগ্রহ করতো, অনুন্নত, অভাবী ইউরোপিয়ানরা। পবিত্র জেরুজালেম দখলের নামে তারা আসতো পালে পালে দফায় দফায়। এর পিছনে যতনা ছিল ধর্মীয় চেতনা, তার চেয়ে অধিক পরিমাণ ছিলো, পার্থিব সুখের দুরন্ত হাতছানি। ফলে ১ম ক্রুসেড হয় ১০৯৫ সালে যা স্থায়ী হয় ১০৯৯ সাল পর্যন্ত। ২য় ক্রুসেড ১১৮৭ সালে সেখানে মুসলিম জেনারেল সালাদিন জেরুজালেম পুনর্দখল করে নেন। এরপর ১১৯৯ সালে ৩য় ক্রুসেড করতে আসে রিচারড এর নেতৃত্বে। রিচারডকে বলা হতো রিচারড, দা লায়ন হার্ট অফ ইংল্যান্ড। রিচারডের নেতৃত্বে জেরুজালেমে ঢুকতে বা দখল নিতে না পারলেও তারা আশেপাশের এলাকা দখল করে প্রায় ১০০ বছর ধরে শাসন করে। তবে তাদের নিজেদের মধ্যে ছিল কলহ আর স্বার্থের চরম দ্বন্দ্ব। এসময় ইউরোপিয়ানরা আরবদের কাছে থেকে অংক থেকে শুরু করে গৃহ নির্মাণ, ইত্যাদি অনেক কিছুই শিখে নেয়। কিন্তু একই সাথে যারা এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা বংশপরম্পরায় মুসলমানদের চরম ঘৃণা করতেও শেখে।
Oxford History Project এর প্রকাশনা থেকে জানা যায় যে, এর কাছাকাছি সময়ে সিল্ক রুট ধরে ভারতবর্ষ ও চীন থেকে সিল্ক, কাগজ, চিনি, সোনা, সিলভার, সুতি কাপড়, চীনামাটির সামগ্রী, মশলা, জুয়েল, চা ইত্যাদি নানান সামগ্রী ইউরোপে নিয়ে যেত ইউরোপিয়ানরা। এই রুটটি তুরস্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তুর্কিরা সে সময় এই রুটের মালামাল পরিবহনের উপর ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে ফলে ইউরোপিয়ানরা বাধ্য হয়েই এই রুটে মালামাল নেওয়া বন্ধ করে সমুদ্রপথে মালামাল নেওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। তাদের টার্গেট ছিল কিভাবে চীন বা ভারতে আসা যায় সমুদ্রপথে। এর ফলে পর্তুগিজ নাবিক Bartholomew Diaz ১৪৮৭ সালে, ক্রিস্টোফার কলোম্বাস তার ২০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ নিয়ে ১৪৯২ সালে ভারতে আসেন। ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে আর Ferdind Magellan ১৫১৯ সালে জাহাজ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেক্রেটারি অফ Magellan এর সেক্রেটারি পিগেফিতা তার নোটবুকে এই সব ভয়েজারের কিছু বর্ণনা লিখে রাখেন যা থেকে সমুদ্র পথের যাত্রার নানা কাহিনী জানা যায়। যা ছিল খুবি ভয়াবহ। এই ভয়বহ অবস্থার জন্য তুরস্কের সিল্ক রুট বন্ধকে দায়ি করা হয় যা, ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম ঘৃণার জন্ম দেয় মুসলমানদের উপর, যা চলে বংশপরম্পরায়।
১৯৬৭ সালে ইসরাইলী সেনারা সিরিয়ার গোলান, মিশরের সানাই উপত্যকা ও গাজা, আর জর্ডানের পশ্চিম উপকূল দখল করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা করে এবং পরবর্তীতে ঐসব এলাকায় ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে ইহুদি ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারীদের উপর চরম ঘৃণার জন্ম হয় ঐ এলাকা তথা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে। যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। এছাড়া ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারত বিভাগের সময় ধর্মকে ভিত্তি করে দেশ ভাগ হয়। ফলে এক পর্যায়ে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার ফলশ্রুতিতে বংশপরম্পরায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু বা মুসলিমরা একে অপরকে চরম ঘৃণা করা শুরু করে যা পরবর্তীতে হয়ে দাঁড়ায় তাদের পারিবারিক সংস্কৃতি। যেমন, ও মুসলমান ওকে ঘৃণা করো, পারলে ওর ক্ষতি করো। ও হিন্দু ওর ক্ষতি করো, হিন্দুরা দেশ বিভাগের সময় আমাদের স্বচ্ছল পরিবারকে ভিখারি বানিয়েছে। ইহুদি আমাদের বাস্তুভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে, আমার বাবা-ভাইকে হত্যা করেছে। যেখানে ইহুদি পাও তার উপর বদলা নাও। ক্রুসেডের নামে আমাদের উপর অত্যাচার করেছে তাই সুযোগ পেলে মুসলমান নিধন করো। মুসলমান বলছে, সুযোগ পেলে খ্রিষ্টান নিধন করো, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ সবই থেকেই জন্ম নিয়েছে হেইট ক্রাইম।
সারা দুনিয়ায় নানা ধরণের হেইট ক্রাইমের দেখা মিললেও জাতিগত বা ধর্মীয় হেইট ক্রাইমের প্রাধান্য সব থেকে বেশি। তাই অন্য ধরণের হেইট ক্রাইমের কথা নাই বলি এখানে। আইএস সারা দুনিয়ায় যে ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের পিছনে কোন শক্তি কী কাজ করছে তাও সবার জানা। কম দামে তেল কেনা আর বেশি দামে অস্ত্র বিক্রি; মানে অর্থনৈতিক স্বার্থই এর মূল কারণ তা বুঝতে আজ আর কারো বাকি নেই। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে নিরীহ ইটালিয়ান বা হলি আর্টিজানে জাপানিজসহ অনেক নিরীহ বিদেশি হত্যার মূলেও কোন কোন দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত তাও এখন ওপেন সিক্রেট। ফলে মুসলমানদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে অনেকে। তাবৎ দুনিয়ার উদার মুসলমানরা খুবই বিব্রত এসব ঘটনায়।
গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ সকালে নিউইয়র্ক সিটির সেন্ট জোন্স হাসপাতালে হেইট ক্রাইমের শিকার হয়ে মারা গেলেন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সন্ধ্যায় নিজ বাসায় ফেরার পথে নিউইয়র্কের জ্যামাইকার রাস্তায় হেইট ক্রাইমের শিকার হন ৭২ বছর বয়সী শাহ আলম। এর কয়েকদিন আগেই কুষ্টিয়ার সাংবাদিক মিঠু চৌধুরীর ইউটিউবে দেওয়া এক খবরে প্রথমে আমি এটা জানতে পারি। পরে তার শরীরের খবর নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে এক সময় এলো চির বিদায়ের খবর।
কুষ্টিয়ার জেলার দৌলতপুর উপজেলার নজিবপুরের সন্তান শাহ আলম। তাকে গেরিলা শাহ আলম বলতেন এলাকায়, কারণ শাহ আলম নামটি অত্র এলাকায় খুব কমন, তাই। ৮ই ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার মিরপুর, ভেড়ামারা ও দৌলতপুর থানা পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমকে দৌলতপুর থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাবরী চুল আর দাড়িওয়ালা শাহ আলম ১৯৭১ সালের পরে আর কোন দিন শেভ করেছেন বলে মনে পড়ে না। অনেকটাই মুক্তচিন্তার মানুষ শাহ আলমের মুখের দাড়ি তাকে মুসলমান হিসেবে হেইট ক্রাইমের শিকার হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ হিসেবে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের কফিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে লাশ বাংলাদেশে পাঠান।
সম্প্রতি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল এই হেইট ক্রাইমের স্বীকার হয়েছেন, যিনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বাংলাদেশের খুব জনপ্রিয় সাহিত্যিক। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনা নিয়ে অনেকে উল্লাস করছে। এই বাংলায় যারা উল্লাস করেছে তাদের অধিকাংশই দেশ ভাগের সময় ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমান। আবার এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় যাওয়া হিন্দু, যারা সেই সময় অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো তারাও সেই দেশে নিরাপরাধ মুসলমানদের উপর অত্যাচার হলে উল্লাস করে। পাকিস্তানেও একই চেহারা দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে, বাংলাদেশে, ভারতে বা পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় কিংবা আফগানিস্তানে এধরণের যে সব অপরাধ দেখা যায় তাদের সবার মূল কিন্তু অর্থনৈতিক কারণ কিন্তু তারা ধর্ম বা জাতিগত বিভেদকে পুঁজি করে এই অপরাধ করলেও তাদের মধ্যে কোন অনুশোচনার লেশ মাত্র দেখা যায় না। কারণ তাদের পারিবারিক সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটাই এমন। তারা ছোটবেলা থেকেই শিখেছে যে, ইহুদি, নাসারা, খ্রিষ্টান, মুসলমান, হিন্দু মারলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে পাপ নেই। যারা উদার ধার্মিক, তারাও তাদের ভাষায় বিধর্মীদের সহায়ক শক্তি, তাদের মেরে ফেলা বা অত্যাচার করা অন্যায় না।
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে যে, এক মণ দুধ নষ্ট করতে এক ফোঁটা গো-চনাই যথেষ্ট। খারাপ কাজ করার জন্য গুটি কয়েক লোকই দেশ, ধর্ম বা জাতির বদনামের জন্য যথেষ্ট। এর মানে এই যে, সব মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি খারাপ না। যারা ক্রুসেডে, সিল্ক রুটের ব্যবসায়, ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সিরিয়ার বর্তমান হতাযজ্ঞ বা ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান যুদ্ধে/দখলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বা লাভবান হননি বা জড়িত নন তাদের মাঝে এসব ঘটনা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছু না। তারা এসব অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। প্রতিবাদ থেকে সচেতনতা– আর তা থেকেই বন্ধ হবে কি এই হেইট ক্রাইম!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)