ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর প্রধান ইফতেখারুজ্জামান আমাদের রাষ্ট্রের ৩ টি প্রধান স্তম্ভের একটি, জাতীয় সংসদকে পুতুল নাচের মঞ্চ বলে কটাক্ষ করেছেন। দ্বিধাহীন ভাবেই বলা যায় এতে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে চরমভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সব রকমের শিষ্টতা লংঘন করে তারা মন্তব্য করেছেন যে একটি অন্তর্বর্তী নির্বাচন ই কেবল জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে পারে।
বিচক্ষণ ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে পারবেন, টিআইবি, বিএনপি আর জামাত কে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, যেই সুযোগ তারা হারিয়েছে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে। সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও আগাম নির্বাচনের জন্য টিআইবির অতি উৎসাহ বিএনপি জামাত জোটের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য তাদের ব্যাকুলতাই প্রমাণ করে। গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে তারা কি ২০১৪ সালের নির্বাচন কে গ্রাহ্য করছেন না? সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি কি হবে, নির্বাচন কি অনুষ্ঠিত হয়নি? যখন বর্তমান সংসদ এর নেতৃত্বে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
এই সময়ে ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অনেক আলোচনা হলেও এই মে মাসের আগে এই কূটনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি। সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব চুক্তি যা দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করবে এই ‘পুতুল নাচের সংসদের’ দ্বারাই সম্ভব পর হয়েছে। এই ‘পুতুল নাচের সংসদে’ মেট্রো রেল প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে যা রাজধানীর তীব্র যানজট নিরসন করবে। সর্বোপরি এই সংসদের সময়েই এক অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাজেট পাস করা হয়েছে।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে যারা মানুষের ভোটের মাধ্যমে এই পর্যায়ে এসেছেন তাদের হেয় করা হয়েছে। টিআইবি কিভাবে সীমা লংঘনের স্পর্ধা দেখিয়েছে তা বোঝার জন্য একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট যে, তাদের কথিত এই পুতুল নাচের সংসদ থেকে প্রথম বারের মত ৪ জন প্রতিনিধি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চপদে আসীন রয়েছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আইন প্রণেতা জনাব সাবের হোসেন চৌধুরি আন্তর্জাতিক সংসদীয় সংস্থা ইন্টার পার্লামেন্ট ইউনিয়নের প্রথম বাংলাদেশি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৩ জন প্রার্থীকে পরাজিত করে এবং তাও সংস্থাটির ১২৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানের মাধ্যমে। একই সাথে জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরি গত বছর কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশোনের চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন।
সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তাঁর সফরকালীন সময় এবং পরবর্তীতে দেশে বিদেশে সর্বস্তর থেকে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন, এমন কি মিডিয়া তাঁকে বঙ্গবন্ধুর পরে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়কের স্বীকৃতি প্রদান করে। এইসব অগ্রগতি কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে না দেখার ভান করে। দাবি করা হয় যে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং তাদের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। এই পরাজয়ের পরে তারা দেশ কে অস্থিতিশীল করার জন্য সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের পথ বেছে নেয় যা কখনো জনসমর্থন পায়নি। তারা পেট্রোল বোমা হামলার মাধ্যমে শত শত নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। তারা কখনো সংসদে যায়নি এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বানচালের জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে।
পরিশেষে তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে, শোচনীয় পরাজয় আঁচ করতে পেরে। গত সিটি কর্পোরেশোন নির্বাচন ও শেষ মুহুর্তে তারা বর্জন করে। পুরো পৃথিবী স্বাক্ষী যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কয়েকজন নেতার যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এরপরেও কিভাবে বিএনপি জামায়াত মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আশা করে? পুরো জাতি যদি তাদের আশা একটি দলের উপর অর্পণ করে সেখানে সংসদের দায় কোথায়? ক্ষমতাসীন দলের কি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ যেখানে একটি দল ভাংচুর, মানুষ পোড়ানো, হত্যাযজ্ঞে ব্যস্ত?
ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে বিভিন্ন উন্নত দেশের সংসদে প্রচুর অনাকাংখিত ঘটনার নজির রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার সংসদ এর ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় সংঘটিত হয় যখন দেশটির একজন নেতা জুলিয়াস মালেমাকে সংসদ থেকে অপমান করে বের করে দেওয়া হয়।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে খ্যাত ভারতের লোকসভায় বিরোধীদলের তীব্র কটুক্তি ও আক্রমণাত্মক আচরণের ফলে স্পীকার সভা স্থগিত করে দিতে বাধ্য হন, ফলশ্রুতিতে কোন বিল পাশ করা ছাড়াই সভা শেষ হয় যার ফলে সরকারকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। মজার ব্যাপার হল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ভারতীয় সংসদে কোনো পুতুল নাচ দেখতে পান না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)