বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ‘আমন্ত্রণে’ যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। সেখানে তিনি জাতিসংঘের পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, আলোচনা হয়েছে তাদের সঙ্গে এবং সাক্ষাৎ শেষে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি।
মির্জা ফখরুলের এই যুক্তরাষ্ট্র সফর এখন আলোচনায়, এবং বিএনপির দাবি জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে গেছেন। যদিও সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিএনপির এই আমন্ত্রণ পাওয়ার দাবিকে বিশ্বাস করেনি; এমনকি দলটির পদস্থ নেতারা এ নিয়ে বিএনপির তুমুল সমালোচনা করেছেন।
আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, জাতিসংঘের মহাসচিবের সাক্ষাৎ পাবেন না তিনি; পানওনি। সাক্ষাৎ না পেয়ে বিএনপিও দাবি করেনি সাক্ষাৎ পাওয়ার। ওই সময়ে গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ছিলেন। ফলে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে মির্জা ফখরুলের এই সফরের যে দাবি ছিল বিএনপির সেটা সত্য বলে বিশ্বাস করা কঠিন, অথবা সোজাসুজি বলা যায় দাবিটা ছিল অসত্য। কারণ আমন্ত্রণ জানিয়ে কাউকে সাক্ষাৎ না দেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক কিছু নয়।
অ্যান্তেনিও গুতেরেসের সাক্ষাৎ না পেলেও বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব সাক্ষাৎ পেয়েছেন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংস্থার সহকারি মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকার। পরেরদিন বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেস্কের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ওই সাক্ষাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন, গণতন্ত্র, খালেদা জিয়ার কারাবাসসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় উড়ে গিয়ে মির্জা ফখরুল বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করাটা আমাদের জন্যে গৌরবের কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন, সরকার, ক্ষমতায় যাওয়া- না যাওয়া, গণতন্ত্র, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলাসহ সবকিছুই বাংলাদেশের জনগণ ও দেশের আইন-আদালতের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু এভাবে বিদেশে উড়ে গিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে আমেরিকা, জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোন বৈশ্বিক সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা এদেশের জনগণের ক্ষমতার প্রতি অবজ্ঞা ও অস্বীকার করারই নামান্তর।
মির্জা ফখরুল যখন নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন তখন গুতেরেস ছিলেন ঘানায়, সাবেক মহাসচিব কফি আনানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কফি আনানের মৃত্যুজনিত কারণে গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে বাইরে ছিলেন এমনও না। প্রকৃতই যদি তার আমন্ত্রণ থাকত তাহলে সাক্ষাতের দিনক্ষণ একদিন-দুইদিন এদিক ওদিক হতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি। এছাড়াও গুতেরেসের আচমকা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যাওয়ায় তার সফরসূচিও পরিবর্তন হতে পারত, কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি।
ফলে ধারণা করা যায় জাতিসংঘের মহাসচিবের এই আমন্ত্রণ জানানোর খবর ছিল অসত্য প্রচারণা। এই প্রচারে বিএনপি লাভবান হয়নি মোটেও, উলটো সত্য সামনে চলে আসায় তারা ক্ষতিগ্রস্তই হলো; বিশ্বাসযোগ্যতাও হারালো।
বিশ্বনেতাদের নিয়ে বিএনপির এমন অসত্য প্রচার নতুন কিছু নয়। এর আগে ভারতের বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ’র সঙ্গে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আলাপ নিয়েও এমন অসত্য প্রচারণা চালিয়েছিল দলটি। বাংলাদেশে এমন আলোচনা যখন চরমে পৌঁছেছিল তখন বিজেপির পক্ষ থেকে সেই টেলিফোন আলাপের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনাগুলো দলটির বৈশ্বিক যোগাযোগের সামর্থ্যের নাজুক অবস্থারই প্রমাণ করছে। শঙ্কার কথা হচ্ছে, এসব বারবার ঘটালেও এ নিয়ে তারা মোটেও সতর্ক থাকছে না, বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর এই ক্ষতিকে গুরুত্বই দিচ্ছে না; অথচ এটা যেকোনো দল কিংবা ব্যক্তির জন্যে সবিশেষ গুরুত্বের।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিএনপির মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী। একাধিকবার সরকারে থাকা একটা দলের মহাসচিবের স্থান নিশ্চয় অনেক উচ্চে। কিন্তু তিনি নিউইয়র্কে গিয়ে যাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন সেই সহকারী মহাসচিব কি উনার সঙ্গে বৈঠকের প্রটোকল রক্ষা করতে পারেন- এটাও প্রশ্ন। এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেস্কের কর্মকর্তার সঙ্গে তার বৈঠকটিও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তার এটা অনুধাবন করা উচিত ছিল বাংলাদেশের চলমান দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে; এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তিনি নিশ্চিতভাবেই সেই সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী হবেন। এমন রাজনৈতিক অবস্থানে থাকা একজন কীভাবে সমূহ প্রটোকল ভেঙে এত নিম্ন-পদস্থদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন সেটাও বিস্ময়।
জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেসের সঙ্গে সাক্ষাতের যে সম্ভাবনা বিএনপি দেখছিল সেটা পূরণ না হওয়ায় তাদেরকে যে কারও সঙ্গে বৈঠক করতে হত এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়ায় হয়ত মির্জা ফখরুল সে বৈঠকগুলো করেছেন। কিন্তু ওসব বৈঠকের ফল যে শূন্য সেটা তিনিও হয়ত বুঝতে পারছেন। তবে মাঝপথ দিয়ে তিনি ও তার দল যে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে নিপতিত হলো সেটা তারা কীভাবে পূরণ করবে?
অন্যদিকে, কেবল জাতিসংঘই নয় বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে তদবির চালাতে বিএনপি ওয়াশিংটনে একটি ‘লবিং ফার্ম’ ভাড়া করেছে বলে খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন পলিটিকো। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করেছেন। তবে বিএনপির এই অস্বীকার প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম তাদের কাছে এমন প্রমাণ আছে বলে জানিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী ১৪ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটের লিংক সেয়ার করে সেখানে বিএনপির সাথে ব্লু-স্টারের চুক্তির ব্যাপারটা দেখার নির্দেশিকাও দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে গত মঙ্গলবার ওই ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আব্দুল সাত্তার নামে বিএনপির একজন’ গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস’ এবং ‘রাস্কি পার্টনার্স’ এর সঙ্গে চুক্তি করেন, যাতে তারা বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির পক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে তদবির করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, এ ধরনের ফার্মের আয়-ব্যয়ের বিবরণী জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই বিবরণীর ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা জানিয়েছে পলিটিকো। যুক্তরাষ্ট্রের এই সাময়িকী হোয়াইট হাউজ, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, প্রশাসনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় অর্থের বিনিময়ে তদবিরকারীদের যোগ্যতা, সক্ষমতা এবং কাজের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিতভাবে তা প্রকাশ করে।
জাতিসংঘে ধর্না, ট্রাম্প প্রশাসনের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক এবং আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগ করে বিএনপি যে কোনোভাবেই লাভবান হবে না সেটা বলে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের নির্বাচন ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলমান ও পূর্বেকার মনোভাব তার সবিশেষ প্রমাণ। এর আগে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি সহ বেশিরভাগ দলই অংশ না নিলেও সে সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকাসহ একাধিক দেশের প্রাথমিক কঠোর অবস্থানও একটা সময়ে পাল্টে যায়। ১৫৪ আসনে ভোটগ্রহণ না হওয়া সে নির্বাচনকেও মেনে নিতে হয়েছে সবগুলো দেশকেই। সে সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে পুরো পাঁচ বছর টিকত না সরকার।
আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের একের পর এক দৌড়ঝাঁপও কোনো কাজে আসেনি। এখনও সে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত, কিন্তু সেগুলোও আগের মত একই ফল ভোগের অপেক্ষায় কেবল।
বাংলাদেশে একাদশ সংসদ নির্বাচন যে হবে না, তা না। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলগুলোসহ সংসদের বিরোধিদল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিও সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিএনপি সে নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা এনিয়ে এখনও প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছে না। তারা এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় অনেকটাই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ রয়েছেন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাগজে কলমে রয়েছেন তারেক রহমান, কিন্তু তিনিও দেশেও নেই; একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত তিনি, এবং আইনের দৃষ্টিতে ‘পলাতক’। সকলেই জানে তার অবস্থান লন্ডনে।
সেখান থেকে তিনি দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন, তবে তার সেসব নির্দেশনা কিংবা বক্তব্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমন অবস্থায় জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন তিনি। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন থাকা একজন নেতা কীভাবে দলকে এগিয়ে নেবেন, কীভাবে সংগঠিত করেন- এমন কঠিন অবস্থায় বিএনপি। এর খেসারত দিতে হচ্ছে খোদ বিএনপিকেই। দল তারেক রহমানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ নিয়ে কেউ মুখ ফুটে বলতেও পারছে না, আবার তিনি নিজেও সেটা অনুধাবন করে দলের স্বার্থে নেতৃত্ব ছাড়ছেন না।
তারেক রহমানের লন্ডনে অবস্থান, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতাদের লন্ডন-আমেরিকায় দৌড়ঝাঁপের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে। ক্ষমতায় যেতে জাতিসংঘ, আমেরিকা-লন্ডনের মুখাপেক্ষি বিএনপি, এমন প্রচার চালাতেও পারছে তারা। এতে করে বিএনপি ক্রমশ জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
ভোটারদের যারাই বিএনপির সমর্থক তারা এখনও জানেন না বিএনপি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর অন্তর্বর্তীকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের যেসব দাবি ছিল বিএনপির সেগুলো পূরণ হচ্ছে না সেটা নিশ্চিত। নির্বাচনে অংশ নিলে দলীয় সরকারের অধীনেই অংশ নিতে হবে- এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান হলেও বিএনপি এখনও সিদ্ধান্তহীনতায়। এমন পরিস্থিতিতে দলকে সংগঠিত করার দিকে দৃষ্টিপাত না করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ আর মহাসচিব জাতিসংঘের মহাসচিবের কথিত আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানে তার সাক্ষাৎ না পেয়ে অন্য কারও সঙ্গে বৈঠক করে আসা কোন অর্থ বহন করে না। এসব স্রেফ সময় ও অর্থের অপচয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক অন্তঃসারশূন্যতার পরিচায়ক। সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ সে ধারণাকেও অবমাননা করা।
জাতিসংঘে গিয়ে কী পেল বিএনপি- এমন প্রশ্ন এখন ওঠেছে। এককথায় উত্তর- ইতিবাচক কিছুই পায়নি। তবে নেতিবাচক যা কিছু যুক্ত তা হচ্ছে- বিএনপির বিশ্বাস বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের মালিক জনগণ নয়, জাতিসংঘ আর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেস্ক! আসলেই কি তাই? মনে হয় না; সত্যি কোনোভাবে মনেই হয় না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)