একদিকে ঘরের বাইরে করোনার কুমির হা করে আছে। অন্যদিকে, কর্মহীন ঘরে ক্ষুধার ভয়ঙ্কর বাঘের গোঙানি। ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ বাংলাদেশের বড় অংশের মানুষের জীবনে আজ এই প্রবাদটি বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। একদিকে প্রতিদিনই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে করোনায় মৃত ও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা; অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়ায় ফুরিয়ে গেছে ঘরের খাবার, অনাহারে থাকাটাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে সহ্যের সীমা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটিরও বেশি। যারা ইতোমধ্যেই বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের বেশিরভাগেরই কোনো জমানো অর্থ থাকে না। যাদের সামান্য থাকে তাদেরটাও ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলালেই চোখে পড়ছে, করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে মানুষ। চলুন দেখে নেয়া যাক তেমন কিছু সংবাদের শিরোনাম।
বাংলাদেশের করোনার পরিস্থিতির সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মারা গেছে ৭৫ জন, আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ১৮৩৮ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে মোট ৫৮ জন। একটি ব্যাপার খুবই উদ্বেগজনক যে সুস্থতার চেয়ে মৃত্যুহার অনেক বেশি।
করোনা পরিস্থিতি যখন ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করছে তখন রাস্তায় বাড়ছে ত্রাণের দাবিতে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলও।
দৈনিক প্রথম আলোর ১৭ এপ্রিলের একটি খবর, ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ বগুড়া ও মাদারীপুরে। এর দুইদিন আগে বিডিনিউজের এক খবরে জানানো হয়, গোপালগঞ্জে ত্রান না পেয়ে সড়ক অবরোধ। ইত্তেফাকের এক খবরে জানানো হয়, বেতন না পেয়ে রাজধানীতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ।
দৈনিক সমকাল জানাচ্ছে, ঘরে খাবার নেই ২৫০ গারো পরিবারের। বিডিনিউজের আরেকটি খবরের শিরোনাম: বেতন পাই না, রিলিফও দেয় না, খামু কী?’
এতো গেল খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষের খবর। কিন্তু মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ক্রমেই দিশেহারা হয়ে পড়ছে। ফেসবুকে দুটো লাইন খুব ভাইরাল হয়েছে, ধনীর আছে ব্যাংকার, গরীবের সরকার, মধ্যবিত্তের আছে শুধু হাহাকার।
বিবিসি বাংলায় এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম: করোনাভাইরাস: বাংলাদেশর মধ্যবিত্তরা সঙ্কোচের কারণে সাহায্যও চাইতে পারছে না।
একদিকে করোনা মোকাবেলায় সবার ঘরে থাকার বিকল্প নেই। অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষকে দিনের পর দিন ঘরে বন্দী রাখলে ক্ষুধার জ্বালায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা। এই উভয়সঙ্কট সামাল দেওয়া সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন বটে। কিন্তু বিশেষঞ্জরা বলছেন এই প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে পরিস্থিতি আসলেই কতোটা সামাল দেওয়া যাবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে কিছু কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী?
বাংলাদেশে খেটে খাওয়া দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা যেমন বিশাল, তেমনি সামর্থ্যবান লোকের সংখ্যাও একেবারেই কম নয়। এখনই উপযুক্ত সময় মানুষ মানুষের জন্য এই অপ্তবাক্য প্রমাণের। সরকার তার মতো করে যতটা সম্ভব ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করুক। কিন্তু এখানে আপনার করোনীয় কী? হ্যাঁ আমি সামর্থবানদের উদ্দেশেই বলছি।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘‘Charity begins at home’’। আপনি সচ্ছ্ল, কিন্তু আপনারই আপন ভাই/বোন অসচ্ছল, বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে অসচ্ছল হয়ে পড়েছেন। আপনি প্রথমে আপনার ভাই/বোনদের যতোটা সম্ভব সহায়তা করুন। আপনার ভাই/বোনদের অবস্থা যদি ভালো থাকে, তবে চাচাতো/মামাতো/খালাতো/ফুফাতো ভাই/বোনদের দিকে নজর দিন।
যদি তাদের অবস্থাও ভালো থাকে তবে আপনার বন্ধু/প্রতিবেশি/সহকর্মীদের দিকে নজর দিন। তাদের অবস্থাও যদি ভালো থাকে। তবে এলাকাবাসীর দিকে নজর দিন। এভাবে যদি আমরা কেবল আপনজনদের সাহায্যে এগিয়ে আসি তাহলে যেকোনো অসহায় মানুষের অভুক্ত থাকার আশঙ্কা কমে আসবে। কারণ এমন একজন অসহায় মানুষও নেই যার কোনো ভাই,বন্ধু,আত্মীয়,এলাকাবাসী ভালো অবস্থানে নেই। আর ছিন্নমূল মানুষের জন্য সরকার নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল।
আসুন, আমরা আপন জনের পাশে দাঁড়াই। করোনা মোকাবেলার সাথে সাথে জয় করি ক্ষুধাকেও।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)