মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ঝটিকা সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের
পক্ষে এটাই কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘সবচেয়ে ইতিবাচক’ অবস্থান।
বিশ্লেষকদের
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরানোর ব্যাপারে মার্কিন অবস্থান আগের চেয়ে
নমনীয় বলেও মনে করছেন। তবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় মার্কিন সহযোগিতার আশ্বাস
সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করছেন তারা।
জন কেরি-শেখ হাসিনার মধ্যে বৈঠকের অন্যতম আলোচ্যসূচি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনার বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে কেরিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘আমি আপনার কষ্ট বুঝি; এ বিষয়টি পর্যালোচনা পর্যায়ে আছে।’
তার এ মন্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর শোক বইয়ে তিনি (জন কেরি) যা লিখেছেন, তা অত্যান্ত স্পর্শকাতর। সেই স্পর্শকাতর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে এটিই মার্কিনিদের হয়ে সবচেয়ে আবেদনমূলক অবস্থান। এই অবস্থান যখন তারা দেখিয়েছে; তখন আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাবের সূচনা হবে।’
তবে ওই আশ্বাসকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও প্রক্রিয়াগত দিকের বিষয়টি মনে করিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, ‘আশ্বাস কতোদিনে বাস্তবায়ন হবে সেটা এখনই পরিস্কারভাবে বলা যাবে না। তাদের মধ্যে প্রক্রিয়াগত কিছু ব্যাপার আছে সেটা যদি তার সম্পন্ন করতে পারে তাহলে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হতে পারে।’
অবশ্য জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় মার্কিন সহযোগিতার বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তারা (মার্কিনিরা) আমাদের কতোটুকু সহযোগিতা করতে চায় এবং আমরা কতোটুকু নিতে চাই; এটাই প্রথমে ঠিক করে নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা অত্যান্ত স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সহযোগিতার মাত্রা এবং ক্ষেত্র কতোটুকু হবে রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আগে ঠিক করতে হবে।’
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জঙ্গিদমন প্রক্রিয়ায় সাফল্য রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জঙ্গিদমন প্রক্রিয়ায় সাফল্যের পরিচয় রাখছে। এটা স্বীকৃত। তবে এ প্রক্রিয়ায় কোন কোন দেশ থেকে সহায়তা গ্রহণ করছে সরকার; সেটা সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই পরিচ্ছন্নভাবে বলা হয়নি। অনুমান করা যায় ভারতীয় সহায়তা বিস্তৃত ভাবে করা হচ্ছে। এই সুবাদে অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকা চাইবে বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্টারেকশন বৃদ্ধি করতে।’
‘এটা তাদের বৈদেশিক রাজনীতির অংশ। ভারত যেমন তাদের আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে আমেরিকাও তাদের বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ হিসেবে আমাদের সহযোগিতা করতে চায়। আমরাও সহযোগিতা নিতে চাই, কিন্তু সেটা তথ্য আদান প্রদান এবং কারিগরি দিক পর্যন্ত সীমিত থাকলে ভালো বলে আমি করি।’
নীতিগত পার্থক্য না থাকলেও পদ্ধতিগত পার্থক্যের কথা তুলে ধরে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘আমি যে জায়গাটাতে গুরুত্ব দেই সেটা হলো জঙ্গিবাদ সম্পর্কে তাদের যে ধারণা অর্থাৎ মার্কিন পারসেপশন এবং বাংলাদেশের পারসেপশনের মিল আছে কিনা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের নীতিগত পার্থক্য না থাকলেও জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ করার ব্যাপারে পদ্ধতিগত পারসপেকটিভে ডিফারেন্স আছে।’
‘মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো দেশ সফর নি:সন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপরও বড় দিক হচ্ছে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে ক্রমান্নয়ে বড় ভূমিকা রাখতে চলেছে, সেজন্য গুরুত্ব এখন বেড়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী সুন্নি রাষ্ট্র যেটা কিনা জঙ্গিবাদের হাতে পড়লে বিশ্বকে অস্থিতিশীল করতে বড় ভূমিকা রাখবে। আবার বাংলাদেশ ভারত মহাসগরে উপকূলীয় দেশ হিসেবে ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। যদি আমারা শুধু বর্তমান পরিস্থিতিতে এর তাৎপর্য খুঁজতে থাকি তাহলে আমার মনে হয় ভুল হবে। এর ফলাফল কিছু হবে ইমিডিয়েট, কিছু হবে লংটার্ম।”
তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলো জঙ্গি আক্রান্ত এবং পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা আমাদের বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পক্ষে কাজ করছে। সেক্ষেত্রে মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্ক কিছুটা হলেও পাকিস্তানকে শক্তি যুগিয়েছে। স্বভাবতই বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে সেটা দক্ষিণ এশিয়াকেও অস্থিতিশীল করে। সেক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের যুক্ত অবস্থান পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের অবস্থান মারাত্মকভাবে কষাঘাত করে। সেক্ষেত্রে ঢাকা হয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর নতুন দিগন্ত সূচনা করতে যাচ্ছে।’
জঙ্গিবাদে বিত্তবানদের ছেলে-মেয়েদের উৎসাহী হওয়ার পেছনে কেরি দায়ী করেছেন এদেশের ছেলে-মেয়েদের প্রচুর পরিমাণে সহিংসতাপূর্ণ ভিডিও গেমস খেলাকে।
তবে এটাকে অন্যতম কারণ বললেও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন, ‘বিত্তবানদের ছেলে-মেয়েদেরকে যেসব বিষয় জঙ্গিবাদের দিকে উৎসাহিত বা প্ররোচিত করছে তার একটি কারণ ভিডিও গেমস। কিন্তু অন্যতম কারণ হচ্ছে দীন ইসলামের অপব্যাখ্যা; যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের কাছে সহজে পৌঁছাচ্ছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে তরুণ সমাজে যে স্বাভাবিক বিদ্রোহী প্রবণতা থাকে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেটাও একটি উপাত্ত।’
এছাড়াও পারিবারিক শিথিলতাকে চতুর্থ উপাত্ত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
জানা গেছে, কেরির সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্য ডিউটি ও কোটা মুক্ত প্রবেশের বিষয়টিও ওঠে আসে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে জন কেরি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য, জ্বালানিসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রেই দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানান। একই দসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অস্ত্র ছাড়া সব বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারেরও সুযোগ চান। সেসময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে জন কেরি বলেন, যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুর্দান্ত কাজ করছে।