জনসেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন এমন ৩৯ ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রশাসন পদক প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৩৯ ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রশাসন পদক-২০১৮ তুলে দেন তিনি। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এই পদক দেয়া হলো। জনপ্রশাসন পদক নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে দুটি ক্ষেত্রে সাধারণ ও কারিগরি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ দল ও শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিতে এ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্তরা ১৮ ক্যারেট মানের এক ভরি ওজনের স্বর্ণপদক, সার্টিফিকেট এবং নগদ অর্থ পেয়েছেন। ব্যক্তিগত অবদানের ক্ষেত্রে একটি স্বর্ণপদক, সার্টিফিকেট এবং জনপ্রতি ১ লাখ টাকা প্রদান করা হবে।
জাতীয় পর্যায়ে সাধারণ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অবদান রাখায় দলগত শ্রেণিতে এ পদক পান ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর রিপন ও সহকারি কমিশনার ভূমি এরশাদ উদ্দিন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান, আইসিটির সহকারী প্রোগ্রামার মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস।
কারিগরি ক্ষেত্রে দলগত পদক পেয়েছেন ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান, সহকারি ভূমি সংস্কার কমিশনার রেজাউল কবীর, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের ন্যাশনাল কনসালটেন্ট মোহাম্মদ এনামুল হক, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ, এম নুরুল আমিন, আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস, কুড়িগ্রামের সাবেক সহকারী কমিশনার আবদুল ওয়ারেছ আনছারী, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক রফিকুল ইসলাম সেলিম এবং কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বাংলাদেশের ব্র্যান্ড নেম সৃষ্টিতে অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের পদক পায় গ্রিসের এথেন্সে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারি সচিব কামরুল আহসান তালুকদার ও নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার শাহাজাহান আলী জাতীয় পর্যায়ে চলতি বছর ব্যক্তিগত শ্রেণিতে জনপ্রশাসন পদক পেয়েছেন। ময়মনসিংহের ভালুকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করায় কামরুল আহসান এবং ভূমি রেজিস্ট্রেশন সেবা ও দলিল ক্যালকুলেটর নামে দুটি অত্যাধুনিক মোবাইল অ্যাপস তৈরি করায় শাহাজাহানকেও একই পদক দেয়া হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে কারিগরি ক্ষেত্রে দলগত শ্রেণিতে পদক পেয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব সমন্বয় ও সংস্কার এন এম জিয়াউল আলম, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব কবির বিন আনোয়ার, এটুআই কর্মসূচির পরিচালক যুগ্ম-সচিব আবদুল মান্নান, পরিচালক উপ-সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মেহেদী হাসান। আর ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে কর্মচারি কল্যাণ কার্যক্রম চালু করায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান শ্রেণিতে পদক পেয়েছে বাংলাদেশ কর্মচারি কল্যাণ বোর্ড। শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা করায় জেলা পর্যায়ের সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শ্রেণিতে পদক পেয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও রেহেনা আকতার। একই ক্যাটাগরিতে নারী উন্নয়নে অবদান রাখায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করায় সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম পদক পান।
উত্তরা গণভবনের সংস্কার ও পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর জন্য দলগত শ্রেণিতে পদক পেয়েছেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজ্জাকুল ইসলাম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বানু, নাটোর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর অনিন্দ্য মন্ডল। স্থানীয় উদ্যোগে গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করায় চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক মোহাম্মদ শওকত ওসমান, সাবেক ইউএনও মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম তালুকদার ও চাঁদপুরের ইউএনও বৈশাখী বড়ুয়া পদক পেয়েছেন।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করায় জেলা পর্যায়ে পদক পেয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াঢাঙ্গী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আ. মান্নান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমান ও ব্যানবেইজের সহকারি প্রোগ্রামার লিয়াজ মাহমুদ লিমন। ডিজিটাল সনদ চালু করায় জেলা পর্যায়ে কারিগরি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শ্রেণিতে এই পদক পেয়েছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খান। একই ক্যাটাগরিতে এক ক্লিকেই অর্পিত সম্পত্তি ইজারা মামলা নবায়ন করার জন্য রাজশাহীর দুর্গাপুরের ইউএনও আনোয়ার সাদাতও পদক জিতেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রকে বিটাক জনপ্রশাসন পদক দেয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবীর বিন আনোয়ারের সঙ্গে। পড়ুন পুরো সাক্ষাৎকারটি।
প্রশ্ন: অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন এই ইস্যুতে আপনি জনপ্রশাসন পদক পেয়েছেন। এর আগেও আপনি এই পদক পেয়েছেন। জানতে চাই অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন কিভাবে সারাদেশে কাজ করে?
কবীর বিন আনোয়ার: নামটা লক্ষ্য করবেন, অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন মানে তথ্য জগতে প্রবেশাধিকার। কার প্রবেশাধিকার? এটি সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার। এর আগে এই তথ্য জগতে প্রবেশের অধিকার ছিল সারাদেশের গুটিকয়েক সংবাদপত্র যারা পড়তেন এবং যাদের বাড়িতে রেডিও ও টেলিভিশন ছিল শুধু তাদেরই। এই প্রকল্পের প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে চেয়েছেন যেখানে তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সেবা সহজীকরণ করা হবে। সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হবে হয়রানি মুক্তভাবে, সময় কম খরচ হবে, অর্থ কম ব্যয় হবে। আমাদের যে প্রচলিত সেবা প্রদান পদ্ধতি আমরা বলছি জনপ্রশাসন জনগণের জন্যে প্রশাসন। এই প্রসঙ্গে এটিও বলতে হয়। আপনারা জানেন এই মন্ত্রণালয় বা এই বিভাগের আগে নাম ছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী এটি আমাদের সামনে তুলে ধরলেন যে, এটি আসলে জনপ্রশাসন হবে। কেননা সংস্থাপন উত্তরাধিকার সূত্রে কলোনিয়াল যুগ থেকে এটি আমরা বহন করে আসছিলাম। এখানে তাই ভিন্ন মাত্রা যোগ হয় এবং এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে কাজগুলো এইগুলো ছিল এটুআই এর মূল লক্ষ্য এবং একেবারে মাঠ পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে- এখানেও প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা না বললেই নয়। তিনি বলেছিলেন সত্যিকারের সেবা দিতে চাইলে তোমাকে গ্রামে যেতে হবে। তখন আমরা আমাদের প্রকল্পের পক্ষ থেকে প্রথমেই যেটি করি সারাদেশে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করি এবং সেখান থেকে এই অনলাইন সার্ভিসগুলো আস্তে আস্তে শুরু হয়। এখন প্রতিটি ডিজিটাল সেন্টার থেকে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ ধরণের সেবা দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও এর বেশিও দেয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন নিয়ে কাজ করছেন? তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার তথ্য অধিকার মানুষের। এখন সবগুলো মন্ত্রণালয়ের পৃথক হোমপেজ আছে এবং যেকোন বিষয়ে অভিযোগ করতে চাইলে মানুষ করতে পারে- আসলে এই সব অভিযোগ কি আমলে নেওয়া হয়? কারা এগুলো সমন্বয় করেন?
কবীর বিন আনোয়ার: আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কাজ করতে শুরু করি তখন আমাদেরও কিন্তু মাইন্ড সেটের পরিবর্তনের জন্য প্রথমে কাজ করতে হয়েছে। অনলাইন সেবাগুলো কতো সহজে কম খরচে হয়রানি মুক্তভাবে দেওয়া যায়- এটি যে একটি ভালো টুল এই তথ্য প্রযুক্তি এটি বোঝাতে হয়েছে আমাদের প্রথমে সবাইকে এবং বিশেষ করে তরুণ সমাজ যারা অত্যন্ত উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে আর্বিভূত হয়েছে তাদেরকে কাজে লাগানো। আর একটা দিক হলো তাদেরকে ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। যেমন আপনারা জানেন যে, এখন আমরা আউটসোর্সিং ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার বিভিন্ন সেক্টর থেকে আইসিটি ডিভিশন থেকে এটুআই থেকে এমনকি মাইক্রোসফট এই ধরণের যারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী তাদের সহযোগিতায় তাদেরকে আউটসোর্সিং ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে এবং ঘরে বসে ছেলেমেয়েরা রোজগার করতে পারছে। অতএব তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের বিষয়টিও আমাদের কাজের মধ্যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ। আর আপনি যেটি বলেছেন সেবার ব্যাপারে? সেখানেও কিন্তু আমরা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করছি? আমাদের জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কেবিনেট সেক্রেটারি পর্যন্ত আমাদের একটা ড্যাশবোর্ড আছে। সেই ড্যাশবোর্ডে কিন্তু ধরা যাক একজন জেলা প্রশাসকের কাছে একজন ভদ্রলোক আবেদন করলেন, তিনি সেই আবেদন কোথায় পাঠিয়েছেন, কোন টেবিলে পেন্ডিং আছে এখন, সেটা কিন্তু ওই ড্যাশবোর্ডে দেখা যায়। কতোদিন পেন্ডিং আছে তাও দেখা যায় এবং এটি মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত দেখতে পারেন। ধরা যাক, খুলনা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে ৩০টি আবেদন পড়ে আছে যে আবেদনগুলো ১৫ দিন হয়ে গেছে কিন্তু অ্যাড্রেস করা হয় নাই। এখন জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়েছে। আরেকটি জিনিস এখন কিন্তু এপিএ অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট হচ্ছে। এখন প্রতিটি দপ্তর প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট মিনিষ্ট্রি তাদের নিজস্ব বাৎসরিক যে কর্মসম্পাদন, তারা কি কি কাজ করবেন, সেইগুলো তারা ঠিক করে দিচ্ছে এবং বছর শেষে সেইগুলোর মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আগে যেমন শুধু এসিআর দিয়ে মূল্যায়ন করা হতো বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন কিন্তু এখন তার কাজের পরিমাণ, তার এক বছরের কর্মপরিকল্পনা সে নিজেই ঠিক করছে। অতএব দিনের শেষে কিন্তু তাকেই হিসাব দিতে হচ্ছে যে, তার কাজ সে কতোটুকু করতে পারলো। আশা করছি এই অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্টের মধ্য দিয়ে আপনার একটা লক্ষ্যমাত্রা সময়ের মধ্যে নির্ধারণ হয় এটার মাধ্যমেই কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের সিভিল সার্ভিসের প্রমোশন বলি বা উপরে ওঠার যে সিঁড়ি তাহলে কিন্তু তাকে এই কাজগুলো করে আসতে হবে। অর্থাৎ জবাবদিহিতা কিন্তু নিশ্চিত করা হচ্ছে। একটু যোগ করতে চাই- আপনারা দেখেছেন যে, সম্প্রতি আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সার্ভিস ট্রিপল নাইন ইনট্রডিউস করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ পুলিশ এখন ট্রিপল নাইনে কিন্তু আপনারা বলতে পারেন, হয়তো আমাদের কাছে অভিযোগ আসে যে, ঠিকমতো অ্যাড্রেস করা হয়নি তবে তার সংখ্যা খুবই কম।