বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে অনেক আগে। জীবন-যৌবন সব বিলিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখতে দেখতে। সাংবাদিকদের সাহায্য করতে করতে। আর কতদিন বাঁচবেন মাঝে মাঝে সেই দিন গোনেন। মাশরাফি কিংবা সাকিব বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন, গ্যালারি থেকে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ চিৎকার ভেসে আসছে- বাকি জীবনে এই দৃশ্য তার দেখা হবে না। সে কথা ভালো করেই জানেন। তবু তার আনন্দ হচ্ছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে; বাংলাদেশকে র্যাঙ্কিংয়ে ছয় নম্বরে দেখে। এই অর্জন তার কাছে শুধু ছয়ে ওঠা নয়, নিজের ক্রিকেট স্মৃতিতে সুখের প্রলেপ এঁকে দেয়ার ক্ষণ।
মোস্তাফিজুর রহমান। নামটা শুনলে পাঠকের কাছে সাতক্ষীরার তরুণ পেসারের মুখটাই ভেসে উঠবে। অনেকের কাছেই অজানা বিসিবিতে আরেকজন মোস্তাফিজুর রহমান আছেন, যিনি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী। ১৯৯৬ সাল থেকে বিসিবির মিডিয়া সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। আজকের বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারকে তিনি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছেন। সবার কাছে তিনি ‘খালু’ বলে পরিচিত।
এত মানুষ থাকতে, আজকের দিনে তাকে নিয়ে কথা বলার কারণ আছে। এদেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা ক্রিকেটের কেতাবি ভাষাটা বোঝেন না। কিন্তু মনেপ্রাণে ক্রিকেট ভালোবাসেন। তারা র্যাঙ্কিংয়ের হিসাব-নিকাশের ধার ধারেন না, কিন্তু আনন্দে ভাসেন। বাংলাদেশে ক্রিকেট সমর্থকদের বড় একটা অংশ শুধু হার দেখতে দেখতে চোখ ভারি করেছেন, যারা এখন জীবনের পড়ন্ত বিকেলে। সাকিবরা আজ বিশ্বকাপ জেতেনি। কিংবা র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরেও ওঠেনি। তবু যে অর্জন এসেছে, তাতে তাদের চোখ ভিজে যাওয়ারই কথা। ‘খালু’ তো সেই ‘তাদের’ই প্রতিনিধি।
‘আমার অনেক, অনেক আনন্দ হচ্ছে। আমি কাল শুরু থেকে বলছিলাম বাংলাদেশ জিতবে,’ খালু ফোনের ওপার থেকে বলতে থাকেন আর আপ্লুত হন। বোঝা যায় গলাটা ধরে আসছে। শেষে যে কথাটা বললেন, মূলত সেই কথা শোনার জন্যই তাকে ফোন করা, ‘এই দিনটির জন্যই তো বেঁচে ছিলাম…।’
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মেহরাব হোসেন অপিও এই অর্জনে গর্বিত, ‘আমরা শুরু করেছিলাম। সাকিবরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি অনেক খুশি। একদিন আমরা বিশ্বকাপও জিতবো।’
‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে ক্রিকেট খেলা রকিবুল হাসান এমন অর্জনের ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা দিলেন, ‘এটা সম্ভব হয়েছে গত দুই বছর ধরে ভালো খেলার কারণে। এই দলটি যখন খেলে, তখন তাদের আসলেই একটা দল মনে হয়। ক্রিকেটে এমন শারীরিক ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কথায় বলে একটা সফলতা, আরেকটা সফলতার জন্ম দেয়। এই সফলতা আমাদের অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের ক্রিকেটের ভিত শক্ত করবে।’
বাংলা ধারাভাষ্যের জীবন্ত কিংবদন্তি আলফাজউদ্দিন আহমেদ। একটা সময় ছিল যখন শ্রোতাদের শুধু ‘মিথ্যে আশ্বাস’ দিয়ে যেতেন। দলের ব্যর্থতা লুকিয়ে ‘প্রাপ্তি’ নিয়ে আলোচনা করতেন। আলফাজউদ্দিন এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। তবু সুযোগ পেলে মাইক্রোফোন হাতে তোলেন। সাকিবদের এই অর্জন দেখে যেতে পারে তিনিও আপ্লুত, ‘বেঁচে থাকতে ক্রিকেটের এমন উন্নতি দেখে সুখে ভাসছি। আমরা এখন ছয় নম্বরে উঠে গেছি। এই অর্জন টনিকের মতো কাজ করবে। বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়েও স্বপ্ন দেখছেন তিনি, ‘ক্রিকেটে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। প্রথম ম্যাচে আমরা যদি কিছু করে দেখাতে পারি, তাহলে অনেক দূর যাব। ইংল্যান্ডকে হারানোর সব যোগ্যতা আমাদের আছে। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা একটু চ্যালেঞ্জিং হবে।’
তার শেষ কথা আর খালুর শেষ কথা মিলে গেল এক বিন্দুতে, ‘এই দিনটির জন্যই তো বেঁচে ছিলাম…।’