চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

৭ দিনের শিশুটিকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা পিঁপড়ার মতো পিষে মারে

সে দিন প্রচুর বৃষ্টি ছিল। বনের মধ্যে ছনের ঘরে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল সব। ছোট সন্তানের বয়স মাত্র ৭ দিন, সদ্য সন্তান হওয়ায় ভীষণ অসুস্থ ছিলেন তিনি। এরই মাঝে তার ঘরে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ২ সদস্য।  ভয়াবহ নির্যাতন চালে তার উপরে। নির্যাতনের একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ৭ দিন বয়সী সন্তানের বুকফাটা আর্তনাদে জ্ঞান ফেরে তার। দেখতে পান হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তার ছোট্ট শিশুটিকে বুটের তলায় পিঁপড়ার মত পিষে মারছে।

এ এক বীরাঙ্গনার গল্প। বীরাঙ্গনা হাজেরা। যিনি মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন সব। হারিয়েছেন সম্ভ্রম, হারিয়েছেন তার ছোট সন্তানটিকে। মিলিটারিরা তার চোখের সামনেই নির্মমভাবে পিষে মারে তার কোলের শিশুটিকে। কোনভাবেই ভুলতে পারেন না সে দিনটির কথা। মনে হলে শিউরে ওঠেন এখনও।

নি:স্ব হয়ে এখন থাকছেন সিরাজগঞ্জের হরিপুর স্টেশনে। থাকার কোন স্থায়ী জায়গা নেই এ বীরাঙ্গনার। কোনরকম একটু মাথা গোঁজার ঠাই বানিয়ে রয়েছেন স্টেশনে। সামান্য ঝড় বৃষ্টিতেই যা ভেঙ্গে পড়ে।

স্বামী আর ৩ সন্তান নিয়ে ভালই কাটছিল বীরাঙ্গনার দিন। ছিল গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু। স্বচ্ছল এ দম্পতি মুক্তিযুদ্ধের সময় রান্না করে খাওয়াতেন ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্বাকে।

হাজেরা তখন গর্ভবতী ছিলেন। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করায় বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। বাড়ির পাশেই ছিল মিলিটারি ক্যাম্প। মিলিটারিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুক্তিবাহীনি সবসময়ই তার বাসায় যাওয়া-আসা করত। মিলিটারিদের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও এড়াতে পারেন না রাজাকারদের। রাজাকাররাই তাদের বাড়িটি চিনিয়ে দেয় মিলিটারিদের।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মুক্তিবাহীনির পরামর্শে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান জঙ্গলে। সেখানেই ছন দিয়ে ঘর তৈরী করে থাকতে শুরু করেন। বাড়ি ছেড়ে পালানোর পরপরই পাকিস্তানী হানাদাররা এসে পুড়িয়ে দেয় তাদের বাড়ি ঘর, ধানের গোলা, গবাদি পশু সবকিছু।

এর কিছুদিন পরই হাজেরার কোল জুড়ে আসে ১ টি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। কিন্তু এই সন্তানই যেন তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ছোট শিশুটির কান্নায় রাজাকাররা খুব সহজেই আন্দাজ করে ফেলেন গহীন জঙ্গলে মানুষের উপস্থিতি। শিশুটির বয়স যখন ৭ দিন তখনই হাজেরার ঘরে অাসে হানাদার বাহিনী। হাজেরার স্বামী তখন না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

হাজেরা প্রাণ বাঁচলেও বাঁচেনি তার সম্ভ্রম। বাঁচেনি সন্তান।

অসহায় এই মায়ের শরীরে সেদিন সামান্য শক্তি ছিলনা নিজের শিশুটিকে রক্ষার। সেদিনের কথা মনে হলে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না এই বীরাঙ্গনা। নিজের অজান্তেই চোখ ফেটে জল নামে তার।

এখানেই শেষ নয়। মিলিটারি চলে যাবার পর অসুস্থ হাজেরা যখন বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন তখন হাজেরার বড় সন্তান পাশের ডোবা থেকে পানি এনে মাথায় ঢেলে হাজেরাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে। সবকিছু শুনে হাজেরার স্বামী মিলিটারিদের পিছু নিলে মিলিটারিরা তাকে গুলি করে। সৌভাগ্যবশত গুলিটি তার পায়ে লাগায় প্রাণে বেঁচে যান।

এরপর ধীরে ধীরে স্বামীর সহযোগীতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন হাজেরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও দারিদ্রতা গ্রাস করে হাজেরার পরিবারকে। মিলিটারিরা সব পুড়িয়ে দেয়ায় নিঃস্ব হয়ে যায় হাজেরা।

তবে শারীরিক সক্ষমতা থাকায় এবার হাজেরা নামেন অন্যরকম যুদ্ধে। শহরে যান। সেখানে তার মত অন্যান্য নির্যাতিত মেয়েদের সঙ্গে নেন হাতের কাজের প্রশিক্ষণ। তবে সংসার বড় হওয়ায় আর গুলি লেগে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণে স্বামীর অসুস্থতার কারণে হাজেরা একা হিমশিম খেতে থাকেন এত বড় সংসার সামলাতে।

এভাবে টানাপোড়েনের মধ্যে কেটে যায় ৬ বছর। অপুষ্টি আর রোগে ভুগে মারা যান হাজেরার স্বামী। ছোট ছোট ৪ সন্তানকে নিয়ে হাজেরা পড়েন অথৈ সাগরে। বীরাঙ্গনা এই নারী বীরের মতই অবতীর্ণ হন জীবন যুদ্ধে। কোনরকম এক বেলা খেয়ে না খেয়ে বড় করে তোলেন সন্তানদের। ১ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি ৩ ছেলে রিকশা চালিয়ে কোনরকম দিন যাপন করে।

থাকার কোন জায়গা নেই হাজেরার। আর তাই সিরাজগঞ্জের হরিপুর স্টেশনের পাশে কোনরকম একটি ঘর তুলে রয়েছেন। স্বাধীনতার ৪৬ বছর অতিবাহিত হবার পরও পাননি কোনও রকম ভাতা বা সুযোগ সুবিধা। ভাতা বইয়ে নাম উঠলেও ভাতা থেকে বঞ্চিত এই নারী। অর্থ, সম্পদ কিছুই চান না হাজেরা। চান শুধু মাথা গোঁজার একটু ঠাই।