এক. ছোটবেলায় আমরা দেখেছি বাংলা বছরের শুরুর দিন আমাদের বসুবাজার লেনের ছোটবড় সবার মধ্যে এক ধরনের আনন্দের দোল খেলে যেত। সে আনন্দের দোল কিভাবে কিভাবে যেন ছড়িয়ে যেত আশেপাশের মহল্লায়ও। হাঁসফাঁস করা প্রচণ্ড গরমের ভেতর চৈত্র মাসের শেষের দিনগুলো যত বৈশাখের প্রথম দিনের দিকে যাওয়া শুরু করত আমাদের ছোটদের মধ্যে আনন্দ আর ঘুরে বেড়াবার উৎকণ্ঠা ততই বাড়তে থাকত।
পহেলা বৈশাখ আসার আগে থেকে আমরা আমাদের বন্ধু নির্মলের নেতৃত্বে কোন কোন মহল্লায় ঘুরতে যেতে হবে, ইসলামপুর-রথখোলা- তাঁতিবাজার- শাঁখারিবাজার- পাটুয়াটুলি না নবাবপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোকানে গেলে আমাদের সারম্ভরে মিষ্টি মুখ করানো হবে- চাই কি এসব উৎসব পার্বণে পাড়া মহল্লার কার কার বাসায় গেলে দু-চার পয়সা আয় রোজগারও হতে পারে তার দিকনির্দেশনাও নির্মলের কাছ থেকে বেশ ভালোভাবেই আমরা পেতাম। নির্মলের বাপ-চাচাদের ছিল রায়সাবাজারে জুয়েলারির ব্যবসা। ও জানে কোথায় গেলে আমরা লাভবান হবো। সুতরাং আমরা কায়দা করে সেইসব দিনগুলোতে নির্মলের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতাম। সারাবছর আমাদের কাছে নির্মলের তেমন একটা মার্কেট না থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, দোল পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূজা, দুর্গা পূজাসহ উৎসব পার্বণে নির্মলের কদর বেশ বেড়ে যেত। মনে আছে, একবার নির্মল আমাদের বন্ধুদের ধূপখোলা মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। একবার রথ খোলা মাঠে চড়ক পূজার খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম চড়ক পূজা দেখে।
পহেলা বৈশাখ আসার আগে থেকে আমরা আমাদের বন্ধু নির্মলের নেতৃত্বে কোন কোন মহল্লায় ঘুরতে যেতে হবে, ইসলামপুর-রথখোলা- তাঁতিবাজার- শাঁখারিবাজার- পাটুয়াটুলি না নবাবপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোকানে গেলে আমাদের সারম্ভরে মিষ্টি মুখ করানো হবে- চাই কি এসব উৎসব পার্বণে পাড়া মহল্লার কার কার বাসায় গেলে দু-চার পয়সা আয় রোজগারও হতে পারে তার দিকনির্দেশনাও নির্মলের কাছ থেকে বেশ ভালোভাবেই আমরা পেতাম।
দুই.
ছোটবেলায় মনে করতাম আমাদের বসুবাজার লেন এলাকাটা এমন এক জায়গায় যেখান থেকে চোখ বন্ধ করে ঢাকা শহরের সব দিকেই বুঝি যাওয়া যায়। মহল্লার বড়দের গল্প করতে শুনেছি এক সময় নাকি ঢাকার বনেদি পাড়া মহল্লাগুলো গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকায়। দেশভাগের আগ পর্যন্ত ফুলবাড়িয়া রেল ষ্টেশনের এপাশের এলাকাগুলোকেই গণ্য করা হতো ঢাকার প্রাণ হিসেবে। আর ফুলবাড়িয়ার ওপারের এলাকা শুরু হয়েছে রমনা থেকে। রমনা এলাকা তখন ছিল বিশাল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সেখানে নানা ধরনের জন্তু জানোয়ারে ভরপুর ছিল। সে আমলে পুরান ঢাকার মানুষজন প্রয়োজন না পড়লে ঐদিকে পা বাড়াত না। মূলত তিরিশের দশক থেকে শুরু হয়ে দেশভাগের পর নানাকারনে ঢাকার বিস্তৃতি বেড়েছে ফলে রমনার ওপার থেকে ঢাকা ক্রমান্বয়ে সরে যেতে থাকে, দূরে অনেক দূরে।
তিন. আমাদের ছোটবেলায় আমরা দয়াগঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ পানির খাল দেখেছি এখন সেই খালের বুকের ওপর দিয়ে বড় এক রাস্তা চলে গেছে ঘণ্টি ঘর হয়ে জুরাইনের দিকে। স্কুল শেষে এই খালে আমরা গোসল করতাম। খালের পাশেই আমার বন্ধু হাসনাতদের বাড়ি ছিল। ওদের বাড়ির সঙ্গেই ছিল পাউরুটি-বিস্কিট তৈরির কারখানা। বর্ষাকালে সেই খাল পানি আর মাছে ভরভরন্ত হয়ে উঠত।
খালের ওপর দিয়ে অব্যবহৃত রেলের ঝুলন্ত পাকা সেতু। একসময়ে এই সেতু দিয়ে রেল গাড়ি চলে যেত গেণ্ডারিয়া হয়ে নারায়নগঞ্জের দিকে। দুরন্ত ছেলেপেলেরা সেই সেতুর ওপর থেকে লাফ দিয়ে খালে পড়ত। স্কুল শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও যেতাম খাল পাড়ে।
নির্মলদের সঙ্গে আমি দয়াগঞ্জের খালের ওদিকটায় গোসল আর ঝাপাঝাপির জন্য যত না গিয়েছি তার চেয়ে বেশি গিয়েছি এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধের জন্য। খালের পাশে জলাজংলা মতো থিক থিক অন্ধকারে মোড়ানো কারখানা থেকে দিনমান ক্ষুধা উদ্রেককারী মন মাতানো ঘ্রাণ সারা এলাকায় ঘুরঘুর করে উড়ে বেড়াত। বাঁশের আড়তের গন্ধের সঙ্গে বিস্কুট কারখানার গন্ধ মিলেমিশে তৈরি করত এই ভুবনের সেরা এক গন্ধ।
তখনকার দিনে পহেলা বৈশাখে আজকের দিনের মতো এরকম ধুম ধাম করে লোক দেখানো ইলিশ পান্তা খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আমাদের ছোটবেলার বৈশাখে বাড়ি বাড়ি ভালোমন্দ খাওয়ার চল ছিল।
আমার বালকবেলায় সেই গন্ধ আমার মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভালো লাগার আবেশ তৈরি করত। আমি গোসল করার সময়, গোসল থেকে ফেরার পথে- ঘরে এসেও সেই গন্ধ পেতাম। কখনো কখনো ঘুমের ভেতরও এই অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আমাকে পাগল করে তুলত।
চার. অনেক কাল আগে আমার বন্ধু নির্মল মারা গেছে। আমাদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পর নির্মলদের বাড়ি ছিল। নির্মল মারা যাবার পর শিখা মাসিরা বাড়িঘর বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেছে।
মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে আমি আমার ফেলে আসা শৈশবের নারিন্দার বসুবাজার লেনে যাই। বিশেষ করে উৎসব পার্বণের দিনগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করি বেশি। সময় সুযোগ পেলে যাইও। গেলে আমি আমাদের বাড়ির সামনের গলিতে হাঁটাহাঁটি করি। কালের গতিপ্রবাহে এখন নতুন নতুন সব মানুষ এসেছে মহল্লায়, তারা তাদের মহল্লায় আমার মতো অর্বাচীনকে দেখে অবাক হয়। তারা অবাকিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা হয়ত ভাবে, বসুবাজার লেনে এ আবার কোন মানুষ!
আমি নির্মলদের পুরনো বাড়ির সামনে দাড়াই। নির্মলদের মাটির ঘর আর নেই। সেখানে উঠেছে দুই ইউনিটের ইটপাথরের পাঁচতলা বাড়ি। আমি নির্মলদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এখনো মাটির ঘরের প্রশান্তি খুঁজে পাই। খুঁজে পাই শিখা মাসির অপার ভালোবাসার স্পর্শ। নাকে এসে ধাক্কা মারে শিখা মাসির হাতে রান্না করা মজার মজার খাবারের ঘ্রাণ। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে রান্না করা শিখা মাসির হাতের অসাধারন খাসির মাংস, পটল আর বেগুন ভাজি, মাস কলাইয়ের ঘন ডাল আর ঘি ভাতের ঘ্রাণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)