‘মুখোশ পড়ে ছেলেটারে ঝুলায়ে পিটাচ্ছে। এসব দেখে টাকা দিলাম কিন্তু ছেলেটারে ছাড়ে না, তারা আবার টাকা চায়। সর্বশেষ ২০ হাজার টাকা ভিক্ষা করে পাঠিয়েছিলাম।’
লিবিয়ায় বাঙ্গালিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা প্রবাসী বাঙ্গালীদের অপহরণ চক্র দ্বারা অপহৃত আইয়ূবের বাবা পঞ্চাশোর্ধ তসলিম প্রামানিক এসব কথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তিনি বলেন, এখন আর টাকা দেওয়ার মত কোন ক্ষমতা নাই আমার। নির্যাতনের ছবি দেখে ছেলের মা স্ট্রোক করে হাসপাতালে আছে। আপনারা আমার ছেলেসহ সবাইরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। এর পর সাংবাদিকদের সামনেই ছেলেকে ফোন করেন তসলিম প্রামানিক। একই ফোনে অপহরণকারীদের সঙ্গে কথা বলে ছেলেকে মারধর না করতে অনুরোধ করেন। এ সময় ফোনের অপর প্রান্তে অপহরণকারী আরো ৫ লাখ টাকা দাবি করায় তখনই জ্ঞান হারান তসলিম প্রামানিক।
পরিবারের ভাগ্য বদলের আশায় ২০১২ সালে নওগাঁর বাসীন্দা আইয়ূব আলী (২৫) পাড়ি জমিয়েছেন লিবিয়ায়। এর মাঝেই চলতি বছরের জুলাইয়ে স্বদেশী কোন ভাই প্রস্তাব দিলেন ইটালি যাওয়ার। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ইটালি যেতে রাজি করিয়ে নিয়ে গেলেন লিবিয়ারই অজ্ঞাত স্থানে। তখনো আইয়ূব বুঝতে পারেননি তিনি আসলে অপহৃত হয়েছেন। এর পর চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। আর সেই নির্যাতনের ছবি-ভিডিও দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে চলতে থাকে মুক্তিপণ আদায়। কয়েকদফায় ৫ লাখ টাকা পাঠানোর পরও মুক্তি মেলেনা আইয়ূবের। বরং নির্যাতন চলতেই থাকে আর মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে সেই অপহরণকারী চক্র।
শুধু আইয়ূব আলী নয়, লিবিয়া প্রবাসী এমন আরো প্রায় ১০০-১২০ জন বাঙ্গালীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে চলছে প্রবাসী বাঙ্গালীদের অপহরণ চক্রটি। ঐ চক্রের বাংলাদেশে অবস্থানরত তিন বিকাশ এজেন্টসহ ছয় সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রোর একটি দল।
আটককৃতরা হলেন, কামাল উদ্দিন (৪৫), নাজনীন বেগম (৩৫), আবু কাশেম (৩৫), বেবী আক্তার (৩৫), মামুন মিয়া (৪২) এবং নুরুল হক (৪৫)।
রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, নওগাঁ এলাকার বাসীন্দা তছলিম প্রামানিক জানান তার ছেলে আইয়ূবকে গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে অপহরণ করা হয়। একই এলাকার বাসীন্দা রাব্বানী জানান, তার ভাই রুবেলকেও আইয়ূবের সঙ্গে অপহরণ করা হয়। তিনিও কয়েকদফায় ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে টাকা পাঠানো বিকাশ নাম্বারের সূত্র ধরে ভৈরব ও নরসিংদী এলাকা থেকে ছয়জনকে আটক করা হয়। বিদেশে প্রবাসী বাঙ্গালীদের ২০-২৫ জন এ অপহরণ চক্রে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জনতে পেরেছি। ঐ চক্রটি ফোন করে দেশে অবস্থানরত নিজেদের পরিবারের বিকাশ নাম্বারে টাকা পাঠাতে বলা হয়। তারপর ভুক্তভোগীর পাঠানো টাকার ভাগ ঐ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের পরিবারের কাছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। বড় ধরনের লেনদেনে কয়েকজন বিকাশের এজেন্টের সম্পৃক্ততা আমরা পেয়েছি।
বিশেষ পুলিশ সুপার বলেন, চক্রটি বিভিন্ন পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় ৫-১০ লাখ টাকা আদায় করার প্রমান পাওয়া গেছে। এ চক্রের সকল সদস্যদের প্রাথমিকভাবে নাম পরিচয় পেয়েছি তবে, এর সঙ্গে বিদেশী কেউ জড়িত থাকার তথ্য আমরা পাইনি।দেশি একটি অপহরণ চক্রের হোতা বাকির মিয়া তার তার ২০ থেকে ২৫ জনের একটি গ্রুপ মিলে এই প্রতারণা করছে। চক্রটি তিন থেকে চার বছর ধরে প্রবাসী বাঙ্গালীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের কাজ করে আসছে।
তিনি আরো বলেন, তবে এ পর্যন্ত মুক্তিপণ পেয়ে কাউকে ছেড়ে দেওয়ার তথ্য আমরা পাইনি। পরিবার যতো টাকাই দিচ্ছে, অপহরণকারীদের ডিমান্ড আরো বাড়ছে। সেই সঙ্গে চলছে নির্যাতনও।
অপহৃতদের উদ্ধারে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা সেখানকার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সেখানকার বাঙ্গালী কমিউনিটিকে বলেছি স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে।