ছাত্রী নিপীড়নে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বহিষ্কারের দাবিসহ চার দফা দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানকে উদ্ধার করেছে ছাত্রলীগ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল নেতাকর্মী আন্দোলনরতদের ওপর হামলা করে। ওই হামলায় নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনকারীদের অনেকেই আহত হয়েছেন। চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যমের খবর।
গত মঙ্গলবার আন্দোলনকারীরা অপরাজেয় বাংলার সামনে জড়ো হয়ে মিছিল করে। ওই মিছিল উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে আসার আগেই নিরাপত্তার স্বার্থে উপাচার্যের কার্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে তালা দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা একাধিক ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে পৌঁছায়। বিকেল পর্যন্ত অবরুদ্ধ থাকেন উপাচার্য। তিনি ওই সময় পেছনের দিক দিয়ে বের হতে চাইলে ওখানে অবরুদ্ধ হন। উপাচার্যকে যখন আন্দোলনকারীরা ঘিরে রাখেন তখন খবর পেয়ে সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী দৃশ্যপটে হাজির হন। তারা আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হন। তাড়া খেয়ে বের হওয়ার সময় বিভিন্ন ফটকের সামনে থাকাদের রড, লাঠি, লাথি, কিল, ঘুষিতে বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের ওই হামলায় কেবল আন্দোলনকারীরাই নন একাধিক সাংবাদিকও আহত হন।
এই ঘটনার পর আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে থাকা বাম সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ছাত্রলীগকে দায়ি করা হয়েছে। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিক্ষোভরতদের উপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, অছাত্রদের কবল থেকে উপাচার্যকে উদ্ধারে গিয়েছিলেন তারা। ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেছেন, ছাত্রলীগ এখানে হস্তক্ষেপ বা মারামারি করতে যায়নি। ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবির এবং কিছু বাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরুদ্ধ এবং তার উপর হামলা করেছে শুনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল ছাত্রলীগ। একই ধরনের কথা বলেছেন জাকির হোসাইন। তার দাবি, বাইরে থেকে অছাত্র, সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ অস্থিতিশীল করার জন্য উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করার খবর শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কতিপয় সহিংস শিক্ষার্থী ও বহিরাগত যুবক রড, লোহার পাইপ, ইট, পাথর নিয়ে উপাচার্য ভবনের তিনটি ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে অশালীন বক্তব্য দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে উপাচার্যের প্রতি বলপ্রয়োগ ও আক্রমণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও শিক্ষার্থীরা মানব বলয় তৈরি করে উপাচার্যকে তার কার্যালয়ে ফিরিয়ে আনে।
ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্যগুলো প্রায় একই। আন্দোলনকারীদের বেধড়ক পেটানোর পর ছাত্রলীগ যে বক্তব্য দিয়েছে তারই পুনরাবৃত্তি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও তাদেরকে আহত করার বিষয়টি তারা বেমালুম চেপে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো আন্দোলনকারীরা আহত হয়েছে, তাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েও চিকিৎসা নিয়েছে। আন্দোলনকারী হলেও আক্রান্তরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাদেরকে ওপর হামলা ও আহত হওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেপে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক হয়নি। যদিও এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, কিন্তু এই তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি অপ্রকাশ্যভাবেই ত নির্ধারণ করে দিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। ফলে এটা কোন পথে যে যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
ছাত্রলীগ স্বীকার করেছে উপাচার্যকে উদ্ধার করতে তারা গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের নাম উল্লেখ না করলেও জানাচ্ছে উপাচার্যের উদ্ধারের কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই উদ্ধার প্রক্রিয়ায় কেন আইনের আশ্রয় নিল না; কেন তাদেরকে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের ওপর নির্ভর করতে হলো। এটা অপরিণামদর্শী ও অর্বাচীন এক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারণেই এমন ঘটনা ঘটল। কিছুদিন আগে নিযুক্ত উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান শিক্ষক নেতা, উপাচার্য হওয়ার পর তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি বিভাগীয় উপকমিটির সদস্য হিসেবেও মনোনিত হয়েছেন বলে সামাজিক মাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত এমন কেউ যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হলে এ ধরনের অনুশীলন অস্বাভাবিক নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আখতারুজ্জামান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নস্যাতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারস্থ প্রথমবারের মত হয়েছে এমন না, এর আগে একাধিক উপাচার্য ছাত্র সংগঠনগুলোর লাঠিয়ালদের হস্তক্ষেপে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বড় প্রমাণ ২০০৫ সালে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী শাহবাগে বাসচাপায় নিহত হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। ওই সময় প্রথমে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটায়। পুলিশি নির্যাতনের মুখে শিক্ষার্থীরা চারুকলায় আশ্রয় নিলে সেখানেও আক্রমণ করে পুলিশ, ভাঙচুর চালায় চারুকলায়। এই নির্যাতন ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানায়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে রোকেয়া হলের প্রক্টর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এসএমএ ফায়েজ নিজেদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধারে ছাত্রদলের সহযোগিতা চাইলে ছাত্রদলের ক্যাডাররা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আহত হন অনেক শিক্ষার্থী।
দিন বদলেছে, সরকার বদলেছে, ভিসিও বদলেছেন; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের লাঠিয়াল বাহিনীর ওপর নির্ভরতার বদল হয়নি। ১২ বছর পর অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজের জায়গায় অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর নাম বদলেছে কেবল, চরিত্র বদলায়নি। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জায়গায় এসেছে কেবল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। নিপীড়নের শিকার হওয়াদের মুখ বদল হলেও তাদের পরিচয় বদল হয়নি, আগেও ছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, এখনও একই।
এবারের আন্দোলন শুরু হয়েছে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত ১৫ জানুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্রদের হুমকি-ধমকি ও ছাত্রীদের ওপর নিপীড়ন করে আন্দোলনকারীদের তাড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা গত ১৭ জানুয়ারি প্রক্টর কার্যালয়ের ফটক ভেঙে প্রক্টরকে অবরুদ্ধ করে। এঘটনার পরের দিন অজ্ঞাতনামা অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র প্রতিনিধিসহ ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনার তদন্ত করা, অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাদের বহিষ্কার করা ও প্রশাসনের করা মামলা তুলে নেওয়া।
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী হবে এনিয়ে এখনই কেউ বলতে পারছে না, কিন্তু এই ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারণে অথবা নিপীড়নে অভিযুক্ত নিজেদের কর্মীদের রক্ষায় ছাত্রলীগ এতে জড়িয়ে গেছে। তাদের নেতাকর্মী, ক্যাডারদের ছবি প্রকাশ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যকার ইস্যুটি এখন ছাত্রলীগ বনাম আন্দোলনকারীদের পর্যায়ে চলে গেছে। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনায় বদনামের ভাগিদার হলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি। অথচ এটা তারা এড়িয়ে যেতে পারত। গায়ে পড়ে নিজেদের ওপর নিয়ে এসে আরও কিছু বদনামের অংশীদার হলো ছাত্রলীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংসদ নেই, নেই শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের আলাদা প্ল্যাটফর্ম। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যোগসাজশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার হামলা চালায় তাহলে দাবি আদায়ের আর কোন পথ বাকী থাকে না।
ছাত্র সংগঠন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে তাহলে দরকার কী ছাত্ররাজনীতি নামের কিছু অব্যাহত রাখার?
ছাত্র সংগঠন হবে শিক্ষার্থীদের, প্রশাসনের লাঠিয়াল হিসেবে নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)