উপমহাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও ইতিহাস অত্যন্ত প্রশংসনীয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দলটি এবং দলের নেতাকর্মীরা সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন এবং তাদের ত্যাগের বিনিময়ের ফলেই আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। কারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে ছাত্রলীগের ভূমিকাও অগ্রগণ্য। স্বাধীনতার সময়েও আওয়ামী লীগ নেতাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেছিল ছাত্রলীগ।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, আগামী মে মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কার্যনির্বাহী সংসদের এক সভায় ছাত্রলীগের সম্মেলনের বিষয়ে নীতিগত এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ছাত্রলীগের কমিটি প্রনয়ণে কৌশলী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, যার মাধ্যমে যোগ্যরা ছাত্রলীগের দায়িত্বে আসতে পারে। এখানে যোগ্য বলতে দলের প্রতি অনুগত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথের অবিচল সারথি, মেধাবী ও কর্মীবৎসল সম্পন্ন কর্মীদের বোঝানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতেও আন্দোলন সংগ্রামে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকাও ছিল প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরেও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের ভূমিকা ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, রাজপথের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের আন্দোলন সংগ্রামের জ্বালানী অনেকাংশেই ছাত্রলীগের মাধ্যমেই আসে। তাই, আসন্ন ছাত্রলীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে পদপ্রত্যাশীদের দোড়ঝাঁপে রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কাদের হাতে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দায়িত্ব অর্পিত হবে। ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব কি সিলেকশন এর মাধ্যমে আসবে, না কাউন্সিলের মাধ্যমে আসবে। তাছাড়া ছাত্রলীগে যে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম শোনা যায় তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে কি দায়িত্বশীল নেতাদের হস্তক্ষেপে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব আসবে না পূর্বের মতোই কমিটি আসবে সে অপেক্ষায় দিন গুনছে পদ প্রত্যাশীরা।
ইতিপূর্বে ৩১ মার্চ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হলেও কোন এক অজানা কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। অনেকেই এমন মন্তব্য করেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্মেলন হলে নতুন কমিটি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কারণ, তাদের সবকিছু চিনতে বুঝতে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে তো একদম নতুন কাউকে নিয়ে আসা হবে না। এমন কেউ উঠে আসবে যারা বর্তমান কমিটিতেই কোন না কোন পদে রয়েছে। নতুন কমিটি আসলে নতুন উদ্যমে দলের জন্য কাজ করতে পারবে। তাছাড়া, আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার চেয়ে প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ আর কেউ নেই। কাজের প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সম্মেলন বানচালের পায়তার কোন ক্রমেই আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের জন্য সুখকর নয়।
নির্বাচনের বছরকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কেননা, মাঠের আন্দোলন, নির্বাচনী প্রচারণা, দলের উন্নয়নমূলক কাজকর্মগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী কমিটি গঠন অত্যন্ত প্রয়োজন। শক্তিশালী কমিটি বলতে, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত, পরীক্ষিত, সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন সিনিয়র কর্মীদের (বয়স অবশ্যই গঠনতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী হতে হবে) সমন্বয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত সিদ্ধান্তই সঠিক হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ, আওয়ামী লীগে একমাত্র তিনিই অনন্য, ১৯৮১ সালে দলের দায়িত্ব নিয়ে নানামুখী অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে দলের জন্য কল্যাণমুখী সব কাজ করে চলেছেন অত্যন্ত সাহসিকতায় ও বিচক্ষণময় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। কাজেই ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যথাযথ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয়কে সকলকে বিবেচনায় নিতে হবে, বিশেষ করে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নতুন কমিটি গঠনে দায়িত্বশীল এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে পরীক্ষিত এবং উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনে। কারণ, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাই প্রধানমন্ত্রীর সামনে নতুন কমিটির খসড়া উপস্থাপন করবেন। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে দলের জন্য অন্ত:প্রাণ কর্মীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। ইতিমধ্যে সিন্ডিকেট মুক্ত কমিটি প্রণয়নের জন্য ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ, নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকরী ভূমিকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পার করার ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে ছাত্র সংগঠনটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। এবারের নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হবে না। কেননা, নির্বাচনে জনমত বৃদ্ধি করা কিংবা সভা সমাবেশকে সফল করার নিমিত্তে ছাত্রলীগের কর্মীদের পেশাগত ভূমিকা দলটির জন্য খুবই ইতিবাচক হয়ে থাকে। অন্যদিকে, কমিটি গঠনে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হতে পারে।
কয়েকটি বিষয়কে মানদন্ডের সূচক হিসেবে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমত: দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটিতে থাকার কারণে সারাদেশে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে এমন প্রার্থীদের কমিটিতে আনা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন: দলের কোন পর্যায়ের কমিটি দেওয়ার পূর্বে পদ প্রত্যাশীদের পারিবারিক ইতিহাস দেখে কমিটিতে পদায়ন করা উচিত। আসন্ন কমিটিতে ছাত্রলীগের শীর্ষপদে এমন কাউকে নিয়ে আসা উচিত নয়, যাদের পরিবারের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের সাথে সংযুক্ততার প্রমাণ রয়েছে।
তৃতীয়ত: রাজনীতিটাকে যারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, ধ্যান জ্ঞান কেবলি রাজনীতি; তাদেরকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে নিয়ে আসা উচিত। কারণ, এমন কাউকে দায়িত্বে নিয়ে আসা উচিত নয় যারা বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য কাজকর্মের সাথে সংযুক্ত।
চতুর্থত: দলের দুঃসময়ে কিংবা রাজনৈতিক প্রয়োজনে রাজপথে সর্বদা আন্দোলন সংগ্রামের সারথি হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন এমন কর্মীপ্রাণ মানুষদের ছাত্রলীগের শীর্ষপদে নিয়ে আসা উচিত।
শেষত: ‘ভাই কোরাম’ না মেনে দলীয় প্রধানের চিন্তা চেতনা প্রসূত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুসরণের জন্য, ছাত্রলীগের ঐতিহ্যকে অনুসরণ ও অনুরণনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কর্মীকে ছাত্রলীগের নেতৃতে নিয়ে আসা উচিত।
এই সব মানদণ্ডের ভিত্তিতে কমিটি প্রণিত হলে ছাত্রলীগের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল নেতাকর্মী ও অন্যান্য সকল সহযোগী সংগঠনের ভূমিকা হতে হবে স্বচ্ছ। কারণ, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে দলীয় কোন্দল। সেই কোন্দল নিরসন ও সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শানিত ভূমিকা পালনের জন্য যৌক্তিক এবং স্বচ্ছ কমিটি প্রণয়ন করা দলের সকলের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। নির্বাচনে জয়লাভের পিছনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই যেভাবেই হোক যোগ্য নেতৃত্বের হাতে সিনিয়র নেতাদের ছাত্রলীগের দায়িত্ব সমর্পণ করা উচিত। ছাত্রলীগের কমিটি হবে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, দেশের মঙ্গলের জন্য প্রতীকস্বরূপ এবং নতুন প্রজন্মের রাজনীতির জন্য আদর্শস্বরূপ। যে নেতৃত্বের পথ ধরে নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা ও সাহস পাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।