বিশ্বকাপের ক্ষণগণনা শেষধাপে পৌঁছেছে। ১৪ জুন, ফুটবল বিশ্বকাপের পর্দা উঠছে। কাঙ্ক্ষিত এদিনে ইতিহাসের ২১তম বিশ্বকাপ আসর শুরুর বাঁশি বাজবে রাশিয়ায়। ১২টি স্টেডিয়ামে ফুটবলপ্রেমীদের চোখ আটকে থাকবে একমাস জুড়ে। মাঠে থাকবে চড়াই-উতরাইয়ের গল্প, আর বাহিরে ঘটন-অঘটনের নানা বাঁক। শেষে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের হাসি ফুটবে একটি দলের মুখে।
রাশিয়া বিশ্বকাপে লড়বে ৩২টি দেশ। কঠিন বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসা দলগুলোর সবারই লক্ষ্য সেরাদের সেরা হওয়া। নেইমারের ব্রাজিল প্রথম দল হিসেবে রাশিয়ার টিকিট কেটেছিল। মেসির আর্জেন্টিনা সেখানে শেষ ম্যাচে এসে মান বাঁচিয়েছে। বিশ্বকাপে অবধারিত ফেভারিট তারা। সঙ্গে রোনালদোর পর্তুগাল, ইনিয়েস্তার স্পেন, গ্রিজম্যানের ফ্রান্স, মুলারের জার্মানি, কোম্পানির বেলজিয়ামের দিকেও নজর রাখতে হবে।
সালাহর মিশর আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে। স্বাগতিক রাশিয়া নিজেদের ছাপ রাখতে বদ্ধপরিকর। সেখানে ইতালি-নেদারল্যান্ডস-চিলির মতো দলগুলো বিশ্বকাপে না থাকার আক্ষেপও সঙ্গী হচ্ছে।
রাশিয়া ১২টি স্টেডিয়ামকে নববধূর মতো করে সাজিয়েছে বিশ্বকাপকে ঘিরে। আয়োজন প্রস্তুতিতে কোনো ফাঁক-ফোঁকর রাখেনি পুতিনের দেশ। বিশ্বকাপের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আয়োজক হয়েছে দেশটি। বিশ্বরাজনীতির অন্যতম পরাশক্তি দেশটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নানামুখী অভিযোগ-উস্কানি, বিপক্ষ পরাশক্তিগুলোর চোখ রাঙানি, আর জঙ্গী হামলার হুমকিকে পেছনে ঠেলে বর্ণিল সাজে সেজেছে।
এক সপ্তাহের পরিক্রমায় সব দলই রাশিয়ার হাওয়া-বাতাসে নিজেদের মনিয়ে নেয়ার কাজটা করেছে। শেষমুহুর্তের ঝালিয়ে নেয়াও সারা। সরগরম দেশটিকে ঘিরে পুরোবিশ্বই ফুটবল জ্বরে কাঁপছে। ফুটবল উৎকর্ষের সবটুকু পসরা সাজিয়ে বসার অপেক্ষা কেবল।
রাজধানী মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে হবে উদ্বোধনী ম্যাচ। মাঠে গড়াবে বৃহস্পতিবার রাত ৯টায়, খেলবে স্বাগতিক রাশিয়া আর সৌদি আরব। তার আগে জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে আটটায়।
বিশ্বকাপে মস্কোর দুটি মাঠ থাকছে। পুরো রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্বকাপের রঙ। দল-সমর্থকদের পাড়ি দিতে হবে দূর-বহুদূরের পথ। খেলতে-খেলা দেখতে পাড়ি দিতে হতে পারে ১৮০০ মাইল পথ। ১২টি স্টেডিয়াম যে ১১ শহরজুড়ে। একেকটি শহরের মাঝে যেমন দূরত্ব আলোচিত, নজর রাখতে হবে আবহাওয়া তারতম্যেও। একইসঙ্গে কড়া রোদ, ঝুম বৃষ্টি আর বরফ জমা ভেন্যুতে খেলা চলবে।
সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন নিয়ে নানা কথা আলোচনা-বিশ্লেষণ জুড়ে। আসর শুরু হওয়ার আগে চ্যাম্পিয়ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা যৌক্তিক, তবে সমাধানে আসাটা বোকামী! বাজীর দৌড়ে ওপরের দিকে আছে আট দল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি, পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, গতবারের রানার্সাপ আর্জেন্টিনা, স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউরোজয়ী পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ফেভারিটদের শীর্ষ তালিকায়। এই দলগুলোর মধ্যে থেকেই হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে চ্যাম্পিয়ন। আবার চমকে দিতে পারে অন্যকেউও। ১৬ জুলাই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষা।
চ্যাম্পিয়ন যে-ই হোক, রাশিয়ায় সবচেয়ে দামি দলের খেতাব পেয়ে গেছে ফ্রান্স। স্পেন, ব্রাজিলের মতো দলকে পরিসংখ্যানে হারিয়ে দিয়েছে তারা। বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়া ফরাসি স্কোয়াডের দাম সবমিলিয়ে ১.০৮ বিলিয়ন ইউরো। তারপরেই অবস্থান স্পেনের। লা রোজার স্কোয়াডের মূল্য ৯৫০ মিলিয়ন। ৯৫০ মিলিয়নে ব্রাজিল তিনে ও ৮৭৪ মিলিয়নে ইংল্যান্ড আছে চারে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির স্কোয়াডের দাম ৮৭২ মিলিয়ন। আর লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার দলের ফুটবলারদের দাম সবমিলিয়ে ৭০৮ মিলিয়ন ইউরো।
স্বপ্নের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো পা পড়েছে পানামা ও আইসল্যান্ডের। ৩ লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যার আইসল্যান্ড চমকে দিতে পারে যেকোনো দলকেই, মাঠের খেলাতে। ২০১৬ ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট দলটি কঠিন গ্রুপে পড়লেও নিজেদের সেরাটা দিতে বদ্ধপরিকর।
মধ্যআমেরিকার অন্যতম ছোট দেশ পানামাও কম নয়। বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরোনোয় জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। কোচ হার্নান ডারিও গোমেজের অধীনে পানামা পরের রাউন্ডে উঠলে অবাক হওয়ার থাকবে না কিছুই!
গত বিশ্বকাপেও সেমিফাইনাল খেলেছে নেদারল্যান্ডস। সেই স্মৃতি হাতড়েই এবারের বিশ্বকাপ পার করতে হবে ডাচ ভক্তদের। কমলা রঙের আলোয় ঝলকাবে না রাশিয়া। তাদের সঙ্গে ইতালির নীল রঙের জার্সিকেও মনে পড়বে ফুটবল ভক্তদের। টানা দুই কোপা আমেরিকা জয়ী চিলিও ব্যর্থ রাশিয়ার প্লেন ধরতে। আর আফ্রিকা অভাব বোধ করবে তাদের আফ্রিকান সিংহ ক্যামেরুনকে।
রাশিয়া বিশ্বকাপে ভিএআর প্রযুক্তির দেখা মিলবে। ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভিএআর প্রযুক্তি এবারই চালু করা হচ্ছে বিশ্বকাপে। পেনাল্টি, লাল কার্ড কিংবা গোল সংক্রান্ত বিতর্ক কাটাতে ফিফা এবারই প্রথম ব্যবহার করছে ভিএআর।
মাঠের খেলা শুরুর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রঙ ছড়াবে। কিকঅফের ৩০ মিনিট আগে শুরু হবে বিশ্বকাপের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ব্রিটিশ রক মিউজিক তারকা রবি উইলিয়ামস প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে থাকবেন রাশিয়ার জনপ্রিয় শিল্পী আইদা গারিফুলিনা।
দুজনের পাশাপাশি মঞ্চে উঠবেন সপ্তম সুরের কিংবদন্তি স্প্যানিশ শিল্পী এবং অপেরা আইকন প্লাসিদো ডমিঙ্গো। তার পরে মঞ্চে উঠবেন আরেক জনপ্রিয় শিল্পী জুয়ান ডিয়েগো ফ্লোরেজ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনাল্ডোও।
উইলিয়ামস নিজের জনপ্রিয় গানের কয়েকটি গাইবেন। সারাবিশ্বের বিভিন্ন ঘরানার ক্লাসিক্যাল মিউজিককে প্রাধান্য দেবেন। ৮০ হাজার দর্শক অনুষ্ঠানটি মাঠ থেকে দেখার সুযোগ পাবে। একই সময়ে শহরের বিখ্যাত রেডস্কয়ারে কনসার্ট হবে। অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০০ নৃত্যশিল্পী থাকবেন। তারা রাশিয়ান সংস্কৃতি তুলে ধরবেন। মিউজিকের উপর বিশেষ জোর দিয়ে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে বেশি নজর থাকবে অনুষ্ঠানে। আর সবপেরিয়ে নজর থাকবে কিকঅফে।