চৈত্রের তাপদাহে মাথায় মুকুট ও ছাতা নিয়ে পাত্র সেজে বিয়ের বাড়িতে উপস্থিত কুনো ব্যাঙ। আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে কনে সেজে পাত্রের অপেক্ষায় বসে আছে সোনা ব্যাঙ। অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হচ্ছে না!
একটু পরই শুরু হবে বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা। সব রীতি মেনেই এমন এক ব্যাঙা-ব্যাঙির বিয়ের পূর্ববর্তী আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া চত্বরে। চৈত্র সংক্রান্ত উপলক্ষে ব্যাঙা-ব্যাঙির বিয়ের এ পানচিনি আয়োজন করে কলা ও মানবিকী অনুষদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনে মহুয়া তলায় বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত চলে বিয়ের পূর্ববর্তীর এ আনুষ্ঠিকতা। বিয়ের পান চিনি অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে উপস্থিত মুড়ি-মুড়কি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আমন্ত্রিত অন্যান্য অতিথিদেরকে।
হিন্দুরীতিতে ধুমধামের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধন পূর্ব এ পানচিনির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। পুরুষ ব্যাঙের মাথায় মুকুট, আর মেয়ে ব্যাঙের মাথায় ঘোমটা পরিয়ে তাদের বিয়ে পূর্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
বর ব্যাঙের প্রতীকী অভিভাবক বাবা হিসেবে ছিলেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক, বিপরীতে মেয়ে পক্ষের অভিভাবক হিসেবে ব্যাঙির বাবা ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি আতিয়ার জামান।
শনিবার বিকেলে আয়োজনে গিয়ে দেখা যায়, বেলা সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবন থেকে বরপক্ষ যাত্রা শুরু করেন। যাত্রায় বাজানো হয় মাইক। ঢাকঢোলের সাথে শুরু হয় নাচ-গান। বেলা ৪টার দিকে ব্যাঙের বাবা (প্রতীকী) ইউসুফ হাসান অর্ক বরকে নিয়ে হাজির হন কনের বাড়িতে।
এসময় কনের বাড়িতে চলছিলো বরপক্ষকে আপ্যায়নের কাজ। বরপক্ষ-কনেপক্ষের বাড়িতে আসার পরপরই শুরু গ্রামীণ ভাষায় তর্ক-বিতর্ক। অনেকক্ষণ যাবৎ চলে দুই পক্ষের কথা কাটাকাটি। তারপর সম্পন্ন হয় আংটি বদল পর্ব। বর ব্যাঙকে আংটি পড়িয়ে দেন কনের বাবা আতিয়ার জামান, কনে ব্যাঙিকে আংটি পড়িয়ে দেন বরপক্ষের অভিভাবক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক।
সবশেষে উভয় পক্ষের প্রতিশ্রুতি মধ্য দিয়ে পান চিনি সম্পন্ন হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী আষাঢ়ে মহা ধুমধামে তাদের মধ্যে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিশ্রুতি শেষে উভয় পক্ষের মাঝে মুড়ি-মুরকি বিতরণ হয়।
পান চিনি অনুষ্ঠানের আয়োজক কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক জানান, বৈচিত্র্যময় জীবজগতে ব্যাঙকুল প্রজাতি প্রকৃতির এক বিস্ময়। উত্তর-আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে আমরা প্রকৃতিতে তাদের ভূমিকাকে অনুধাবন না করে জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে তাদের অবহেলা করছি। এই অবহেলার দায়মুক্তির লক্ষ্যেই চৈত্র-সংক্রান্তির এই শেষ লগ্নে তাদেরকে বর-কনে রূপে সবার সামনে নিয়ে আসা।
প্রকৃতিতে ব্যাঙের ভূমিকার কথা উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, ব্যাঙকুল প্রাণী নীরবে, নিভৃতে, নিজেদেরকে অনেকটা আড়ালে রেখেই জীবজগতের বৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিরন্তর ভূমিকা রাখছে। প্রকৃতিতে প্যাঁচা যেমন প্রতিদিন ক্ষতিকর ইঁদুর ধরে শত শত, তেমনি ব্যাঙ ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
‘‘ব্যাঙের প্রিয় খাদ্য ক্ষতিকর পোকা, আমরা দমন করছি রাসায়নিক বিষ প্রয়োগে। আমরা ব্যাঙের আহারসহ বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছি নিরন্তর। আমাদের অত্যাচারেই ব্যাঙের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দিন দিন। ফলে ধেয়ে আসে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অনেক ক্ষতির পরে আমরা এখন বুঝি সকল জৈববৈচিত্র মিলেই আমাদের প্রকৃতি। এর নিবিড় বন্ধনে থাকাটাই আমাদের জন্য শ্রেয়।’’
অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষিত হলেও সুশিক্ষিত নই। আমাদের পূর্বসূরিদের শিক্ষা ছিল না, কিন্তু প্রকৃতি জ্ঞানে ছিলেন তারা সমৃদ্ধ। তারা ধ্রুবতারা দেখে দিক নির্ণয় করতেন, ঘর বা গাছের ছায়া দেখে সময় নিরূপণ করতেন, ব্যাঙ প্রকৃতির অসীম ক্ষমতাকেও তারা অনুধাবন করেছিলেন। আর এ কারণেই তারা মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাশায়, ব্যাঙ প্রজাতির সুখ, সমৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার কামনায় আষাঢ়ে অনেক ঘটা করেই ব্যাঙ যুগলের বিয়ে দিতেন।
অনেক পরে হলেও এর তাৎপর্য আজ আমরা অনুধাবন করেছি। তাই চৈত্র-সংক্রান্তির এই সাঁঝের বেলায়, ঘটা করেই ব্যাঙের পান-চিনির অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। আমরা কথা দিচ্ছি আগামী আষাঢ়ে তোমাদের বিয়ে হবে। পান-চিনি অনুষ্ঠানের পর এক বড় সরোবরে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। এতে ভেলায় চড়ে তোমরা ঘুরে বেড়াবে।