পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আজীবন যোদ্ধা, কল্পনার চেয়েও বিশালতার অধিকারী এর্নেস্তো চে গুয়েভারার মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর নির্মমভাবে খুন হন তিনি। তবে আর্জেন্টিনার রোসারিওতে জন্ম নেওয়া এই মহান বিপ্লবী এখনও কোটি কোটি মানুষের নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস, এক অসীম ভালোবাসা, রূপকথা এবং সুন্দর স্বপ্নের নাম।
‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/ আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা/ আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ/ শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস…/ বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা/ তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর/ তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে/ নেমে গেছে/ শুকনো রক্তের রেখা…|’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কবিতা ছাড়াও চে’কে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় যত কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, তথ্যচিত্র, গান, চলচ্চিত্র, শোকগাথা রচিত হয়েছে তা সত্যিই বিরল। এত লেখালেখি হয়ত আর কোন বিপ্লবীকে নিয়ে হয়নি।
‘আমার জন্ম আর্জেন্টিনায়, গুয়েতেমালায় বিপ্লবী হয়েছি, কিউবায় লড়েছি, কিউবান হয়েছি। আমি একজন লাতিন আমেরিকান। আমি লাতিন আমেরিকার যেকোন দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগে প্রস্তুত। বিনিময়ে আমার কিছুই চাওয়ার নেই।’ স্বপ্ন, আদর্শ আর সংগ্রামের প্রতি এমন অবিচল, দৃঢ় অবস্থান ছিল এই বিশ্ববিপ্লবীর।
১৯২৪ সালের ১৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন আর্জেন্টাইন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, ডাক্তার, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবায় বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব চে।
পারিবারিক আবহেই তিনি পেয়েছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, পেয়েছেন তিন হাজারেরও বেশি বই। বই ভীষণ ভালোবাসতেন চে, ভালোবাসতেন কবিতা।বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী, লুটেরা, ধনিক শ্রেণীর আতঙ্ক আর মেহনতি, শ্রমজীবী, সংগ্রামী মানুষের বন্ধু চে’র ছিল বর্ণাঢ্য জীবন। তিনি তার সেই জীবনের কিছু অংশ ‘মোটরসাইকেল ডায়েরি’, ‘বলিভিয়ার ডায়েরি’ ও ‘ডাক দিয়ে যাই’ নামক তিনটি গ্রন্থে লিখে গেছেন।
চে গুয়েভারা ১৯৪৮ সালে বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবার্টো গ্রানাডো নামক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্রতা দেখে ভীষণভাবে মর্মাহত হন। ভ্রমণকালে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ। আর এর একমাত্র সমাধান হিসেবে তিনি দেখেন সমাজতন্ত্রিক বিপ্লব।
রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়েতামালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পঞ্চাশের দশকে ফিদেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কবিতা আর বিপ্লব চিরসঙ্গী হয়ে ওঠে। কিউবায় স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে টানা আড়াই বছর গেরিলা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সফল করেন। কিউবার মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি দেশটির নাগরিকত্ব লাভ করেন। নতুন সরকারের একাধিক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চে। এর মধ্যে ছিল বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শিল্পমন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, সামরিক বাহিনীর ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন ও কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বভ্রমণ।
১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌঁছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন। এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন।
১৯৬৬ সালের শেষের দিকে বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কথা বলেই কিউবার কয়েকজন কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে বলিভিয়ায় আসেন চে গুয়েভারা। বলিভিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে শ্রমজীবী, নিপীড়িত মানুষের সরকার গঠনের প্রস্তুতি নেন চে গুয়েভারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিছু অসহযোগিতার কারণে সফল হননি। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর মার্কিন মদদপুষ্ট বলিভিয়ার বাহিনীর হাতে কিছু গেরিলা যোদ্ধাসহ ধরা পড়েন এবং নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন তিনি।